কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে কত যে অজানা প্রতিভা হারিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন তার হিসেব আমরা কেউ এই রাখি না। তবে কিছু কিছু প্রতিভা আত্মবিশ্বাস আর স্বনির্ভরতার জোরে নিজেদের স্বপ্ন গুলিকে মাত্রা দিয়েই ছাড়ে। ঠিক সেইরকম মাত্রা ছোঁয়া একটি ছেলের জীবনের গল্প আমি তুলে ধরতে চাই আজ আপনাদের সামনে।
জলপাইগুড়ি জেলার একটি ছোট্ট গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান অসীম কুমার পাল। অজানা অচেনা জিনিসের প্রতি জানার আগ্রহ থেকে শুরু করে সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক সব ছোট থেকেই । আর তার অনুসন্ধিৎসু মনের আত্মপ্রকাশ ঘটে একটি বাংলা সাহিত্য কেন্দ্রিক সাইট খোলার মাধ্যমে। আর তার এই সাইটটি আজ শুধু তার নয় সেটি আজ প্রায় পনেরো লক্ষ মানুষের সাথি। তবে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে বড়ো হয়ে ওঠা অসীমের পক্ষে এই সাইটটি নিয়ে এগিয়ে চলার পথ মোটেও সহজ ছিল না।
অসীম যখন মাধ্যমিক পাশ করে , নবান্ন থেকে একটা স্কলারশিপ পায় ১০,০০০ টাকার। সবসময় কিছু করার আবেগ তাড়িত মন বারংবার তাগাদা দেয় তাকে কিছু করতেই হবে নিজেকে সবার থেকে আলাদা কিছু করে দেখাতেই হবে। অনেক ভেবে চিন্তে সে সিদ্ধান্ত নেয় মোবাইল নয় ল্যাপটপ আগে কিনবে ।
তাই স্কলারশিপের সেই টাকাটি সাথে বাবার দেওয়া পাঁচ হাজার টাকা আর ছোট থেকেই জমানো কিছু টাকা, সব মিলিয়ে একটি ল্যাপটপ কিনে নেয়। ল্যাপটপ কেনা হলেও , সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় ইন্টারনেট পরিষেবার অভাব। তার দিদার দেওয়া কিছু অর্থ দিয়ে একটি রাউটার কেনে ইন্টারনেটের জন্য।
এরপর তার পরিচয় হয় ইউটিউবের সঙ্গে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে পিছু ছাড়েনি সেটা আবার প্রমাণিত হয় । তাঁর প্রিয় ল্যাপটপটি মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই খারাপ হয়ে যায়। কষ্টে কেনা জিনিস নষ্ট হলে মাথা যে ভ্রষ্ট হয় সেটা সবার জানা।
এরপর কেটে যায় একটা বছর , তার হাতে প্রথম স্মার্টফোন আসে কলেজে পড়ার দ্বিতীয় বর্ষে। সেই স্মার্টফোন কেনে স্কলারশিপের টাকা দিয়েই। ইতিমধ্যে আবার আরেকটি স্কলারশিপের টাকা সে পায়। কিন্তু ভাগ্য দেখুন। সেই টাকা প্রায় পুরোটাই চলে গেল কলেজে অ্যাডমিশন হতে আর বাকি কিছু দরকারি জিনিস কিনতে।
কলেজে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে ১২০০০ টাকার স্কলারশিপের অঙ্ক টা ১৮০০০ টাকা হয়ে যায়। এই ১৮০০০ টাকা আর সাথে মামার কাছে সাহায্য চেয়ে পাওয়া কিছু টাকা দিয়ে সে আরেকটি ল্যাপটপ কেনে ।
বাকিদের মত সেও একটি ইউটিউব চ্যানেল খোলে। সেখানে অজানা তথ্য নিয়ে নানান ভিডিও বানাতে থাকে । কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সে বুঝতে পারে , এই সব ভিডিও বানানো তার জন্য নয়, কেননা সে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আর কয়েকজনের দেখে ভিডিও তো বানাচ্ছে কিন্তু নিজের মন কে বোঝাতে পারছে না । এরপর ভিডিও বানাতে এক ঘেয়েমি লাগতে শুরু করে তার। তাই সে আবার ইউটিউবে সার্চ করে নতুন কিছু সৃষ্টিশীল তৈরি করার মানসিকতা নিয়ে।
সেখানে সে জানতে পারে ব্লগিং সম্পর্কে। ইউটিউব দেখেই ইউটিউবারের কথা মত সে একটি লিরিক্স সাইট খুলে, গুগল এর ফ্রি ওয়েব হোস্টিং ব্লগার এ। কিন্তু এই লিরিক্স আপলোড এও তার মন বসেনি। বারবার মনে হতে থাকে এটাতেও তার আগ্রহ জন্মাচ্ছে না।
এদিকে কলজের দ্বিতীয় বর্ষে আবার স্কলারশিপের টাকা পেলে, সে বাড়িতে না জানিয়েই কিনে ফেলে সার্ভার আর ডোমেইন। এরপর জন্ম হয় charpatra.com (ছাড়পত্র) নামে সাহিত্যানুরাগীদের সাইটটির।
অবশ্য প্রথমে সে এই সাইটটিতে সাহিত্য চর্চা নয় বরং নানা অজানা তথ্য নিয়ে লিখত। কিন্তু কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও প্রতিদিন দর্শক সংখ্যা টেনে-টুনে ১০ জন অবধি গড়াতো । আর এই দর্শক আসত অনেক জায়গায় লেখাটিকে শেয়ার আর সবাইকে ম্যাসেঞ্জারে শেয়ার করার মাধ্যমে ।
ইন্টারনেট থেকে ইনকাম করার ভাবনা নিয়ে যে যাত্রা সে শুরু করেছিল, সেই ভাবনার পরিবর্তন ঘটে , সে বুঝতে পারে ইন্টারনেট থেকে ইনকাম করা একদমই সহজ ব্যাপার নয়।
প্রথম এক বছরে ছাড়পত্রের মোট দর্শক সংখ্যা মাত্র ৭০০ জনের আশেপাশে হয় ।
এরপর নিজের লেখা একটি গল্প সে ছাড়পত্র তে আপলোড করে , আর তার নজরে আসে সেই লেখাটি মানুষ বেশ ভালোবাসছে। আর এরপরেই নিজের ডায়েরীর পাতায় পরে থাকা গল্প গুলো জিয়ন কাঠির ছোঁয়া পায় ছাড়পত্রের মাধ্যমে।
ইতিমধ্যে সাইটটি গুগল অ্যাডসেন্স এর অনুমোদন পায়। কাজ করার ইচ্ছে আরও অনেক বেড়ে যায় তার। জানলে অবাক হবেন , মাত্র এক ডলার ইনকাম করতে তার সময় লেগেছিল প্রায় দেড় বছর।
এভাবেই গুটি গুটি পায়ে ছাড়পত্রের এগিয়ে চলে।
নতুন নতুন যারা লেখালেখির দুনিয়ায় আসে তাদের সর্বদা অগ্রাধিকার দেওয়া হয় ছাড়পত্রতে। আর তাই ধীরে ধীরে কয়েকজন নবীন লেখক-লেখিকা ছাড়পত্রকে নিজেদের লেখার মাধ্যমে সমৃদ্ধ করে।
ছাড়পত্রের প্রথম পেমেন্ট আসে প্রায় হাজার দশেক টাকা। ইনকাম করার মানসিকতা নিয়ে যে ছাড়পত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ছাড়পত্রের হাত ধরে আসা অর্থ নিজের পকেটে ভরার মত মানসিকতা জন্মায় নি অসীমের ,
তাই সেই অর্থ নিয়ে সে ছুটে যায় একটি আশ্রমে। এরপর ছাড়পত্রের মাসিক ইনকাম সেই আশ্রমেই দেওয়ার ব্যবস্থা করে সে।
গুটি গুটি পায়ে এগোতে এগোতে ছাড়পত্র আজ প্রায় ১.৫ মিলিয়ন পাঠকের ভালোবাসায় পূর্ণ হয়েছে আজ । যে ছাড়পত্র তার ব্যক্তিগত ছিল সেই ছাড়পত্র আজ সবার ছাড়পত্রতে পরিণত হয়েছে । আর এই ছাড়পত্র সমস্ত টাই সাহিত্যানুরাগী এবং সেই আশ্রমিক দের উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত।