google-site-verification=r3lYzE3jI5XC8igrXRKdm9HAWALrzmx6coPmyeHNww4
Spread the love

পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি প্রাচীন জনপদ কুলীনগ্রাম ।চৈতন্যদেবের পদধূলি ধন্য এই জনপদ। পুরীর জগন্নাথদেবের রথ যাত্রার সঙ্গে আজও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই কুলীন গ্রামের নাম। এখানকার রথযাত্রা উৎসব ৫০০ বছরেও বেশি সময়ের পুরানো।চৈতন্যদেবের আদেশ অনুযায়ী পুরীর জগন্নাথের রথের জন্য এই কুলীনগ্রাম থেকেই পাঠানো হত রেশমের পট্টডোরী।পুরীতে পৌছে দেওয়া হয় পট্টডোরী দেওয়া রথের অনেক আগেই কুলীনগ্রাম থেকে।সেই প্রথা এখন আর নেই। তবে কুলীন গ্রামের রথ আর পুরীর রথ মাহাত্ম্য একই বলেই আজও বিশ্বাস করেন এখানকার ভক্তরা ।

তবে পট্টডোরী প্রসঙ্গে লোককাহিনী বলে নেওয়া প্রয়োজন।বাংলায় ভ্রমণ করছিলেন তখন গুণরাজ খানের পুত্র সত্যরাজ খান বা লক্ষ্মীকান্ত ও তার ছেলে বসু রামানন্দ। এনারা ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের বিশেষ অন্তরঙ্গ সহচর ছিলেন। তখন কুলীনগ্রামবাসিদের একটি সঙ্কীৰ্ত্তনের দল ছিল। পুরীতে রথে শ্রীচৈতন্যদেব যখন নৃত্য করছিলেন, তখন এই কুলীনগ্রামের কীৰ্ত্তন দল সেই নাচের সাথে নাচে মেতে ওঠেন। এদিকে জগন্নাথদেবের পুনর্যাত্রার সময় একটি পট্টডোরী বা রজ্জ্ব ছিঁড়ে যায়। শ্রীচৈতন্যদেব ঐ পট্টডোরীর ছেড়া অংশ নিয়ে রামানন্দ বসুকে বলেছিল— “ এই পটডোরীর তুমি হও যজমান। প্রতি বর্ষ আনিবে ডোরী করিয়া নিৰ্ম্মাণ।” সেই থেকেই কুলীন গ্রামের বসু বংশ জগন্নাথদেবের পটডোরী দিতো। আগে কুলীনগ্রাম থেকে পট্টডোরী না পৌছানো পর্যন্ত পুরীতে জগন্নাথদেবের রথ টানা হতো না।
এই বসু রামানন্দ একজন পদকৰ্ত্তা ছিলেন। বৈষ্ণব সাহিত্যে তাহার নামের ভনিতাযুক্ত অনেক সুন্দর সুন্দর পদ আছে। আবার “ যবন হরিদাস ’ যিনি পরম ভক্ত ব্ৰহ্ম হরিদাস ঠাকুর, তিনিও বহু দিন কুলীনগ্রামে থেকে ছিলেন। তাই কুলীনগ্রামে বৈষ্ণব ধর্মের বিশেষ প্রসার ঘটে।
কথায় বলে

“কুলীনগ্রামীর ভাগ্য কহনে না যায়।
শূকর চরায় ডোম সেহ কৃষ্ণ গায়।”
কুলীনগ্রামের দক্ষিণে নির্জন স্থানে হরিদাস ঠাকুর সাধন ভজন করেছিলেন তার আজ হরিদাস ঠাকুরের পাটবাড়ী নামে পরিচিত। এই পাটবাড়ীর মন্দিরে গৌরাঙ্গদেব ও হরিদাস ঠাকুরের মুর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে। যে কদম গাছের তলে হরিদাস ঠাকুর সাধন করতেন তা আজো এখানে আছে। কথিত আছে যে চৈতন্যদেব এইখানে পদার্পণ করেছিলেন। প্রতি বৎসর অগ্রহায়ণ মাসের শুক্ল ত্রয়োদশী তিথিতে গৌরাঙ্গদেবের আগমন সমরণ ও মাঘ মাসের শুক্ল চতুর্দশীতে হরিদাস ঠাকুরের তিরোভাব উপলক্ষে এইখানে মেলা ও মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
কুলীনগ্রামে বহু প্রাচীন কীৰ্ত্তি আছে।এর মধ্যে শিবানীদেবী, গোপেশ্বর মহাদেব, মদনগোপালজীউ ও গোপীনাথের মন্দির সমধিক বিখ্যাত। আদ্যশক্তি শিবানীদেবীর মুর্তি পাষাণময়ী। মন্দির গায়ের লিপি থেকে জানা যায় যে ৯৬৩ শকে অথাৎ ১০৪১ খৃষ্টাব্দে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। শিবানী মন্দিরের পাশে লুপ্তস্রোতা কংস নদীর খাত দেখা যায়। গোপেশ্বর মহাদেবের মন্দির কুলীনগ্রামের বিখ্যাত সরোবর গোপালদীঘির নৈঋত কোণে অবস্থিত। এই মন্দির গায়ের একটি লিপি জানতে পারা যায় যে ১৬৬৬ শকে কুলীনগ্রামের অন্তর্গত চৈতন্যপুর নিবাসী নারায়ণ দাস নামক জনৈক ব্যক্তি এই মন্দিরের সংস্কার করেন।
চৈতন্যপুর কুলীনগ্রামবাসী বসুবংশের অন্যতম বাসস্থল ছিল। চৈতন্যদেবের নামানুসারেই এই স্থানটির এইরূপ নামকরণ হয়েছে । এই গ্রামের চতুদিকে গড় ছিল। সাধারণ লোকে আজও একে “রামানন্দ ঠাকুরের গড় বাড়ী ’ নামে ডাকে।

এবার আসি এইগ্রামের বসু পরিবারের কথায় ।কুলীনগ্রামে রথ যাত্রা উৎসবের সুচনা করেছিলেন এই পরিবারটি।পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কুলীন গ্রামে জন্মগ্রহন করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অমূল্য গ্রন্থ ’শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যের ’রচয়িতা মালাধর বসু।শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগে পূর্ব বর্ধমানের কুলীনগ্রামের ভূমিপুত্র মালাধর বসু এই কাব্য রচনা করেছিলেন। তবে স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব বর্ধমানের কুলীনগ্রামে এসে তিনদিন থাকেন বলে চৈতন্যমঙ্গল কাব্যে উল্লেখ রয়েছে । এই মালাধর বসুর পৌত্র লক্ষ্মীকান্ত বসু একসময় সত্যরাজ খান নামে ভূষিত হয়েছিলেন ।আগে বলেছিপুরীর জগন্নাথ দেবের রথের জন্য কুলীনগ্রাম থেকে পট্টডোরী পাঠানোর আদেশ সত্যরাজ খানকে করেছিলেন স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব।। বছর পাঁচ-দশ হল সেই প্রথা বন্ধ হয়েছে।তবুও আজ রথের দিন ভিড়ে জমজমাট থাকে ইতিহাস প্রসিদ্ধ কুলীন গ্রামের রথযাত্রা উৎসব প্রাঙ্গন ।
বৈষ্ণবতীর্থ কুলীনগ্রামটি জামালপুর খানার আবুজহাটী ২ নম্বর পঞ্চায়েত এলাকায় অবস্থিত।পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এই গ্রামেই মালাধর বসু জন্মগ্রহণ করেন। তার পৌত্র রমানন্দ বসু ছিলেন চৈতন্যদেবের খুবই অন্তরঙ্গ। শোনা যায় বসু পরিবারের আমন্ত্রণেই চৈতন্যদেব কুলীনগ্রামে এসেছিলেন। এই পরিবারের পাঠানো পট্টডোরি অর্থাৎ কাছি দিয়ে পুরীর রথের সঙ্গে বাঁধা হত জগন্নাথ ,বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ । এমনকি এই পট্টডোরী মালার মতো করে এই তিন দেবতার গলায় পরানো হত। তবে এখন এই প্রথা আর চালু নেই।
কুলীন গ্রামের মধ্যস্থলে রয়েছে জগন্নাথ দেবের মন্দির।প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখানে নিমকাঠের তৈরি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার এই বিগ্রহের পুজোপাঠ হয়ে আসছে। রথ যাত্রা উৎসবের আগে এই বিগ্রহ নতুন রঙে সাজানো হয়। দারুব্রহ্ম রূপী ভগবান জগন্নাথ কৃষ্ণ বর্ণের শঙ্খ চক্রধারী, ভগবান বলভদ্র শ্বেত বর্ণের গদা এবং হলধারী ও দেবী সুভদ্রা হরিদ্রা বর্ণের,বিগ্রহের সুন্দর গোল গোল চোখ। এই জগন্নাথ মন্দিরে প্রভু জগন্নাথের সাথে পূজিত হচ্ছেন কোষ্ঠী পাথরের পাল যুগীয় অনন্ত বাসুদেবের বিগ্রহ, শঙ্খ , চক্র , গদা , পদ্মধারী ভগবান বিষ্ণু সাথে শ্রীদেবী ও ভুদেবী এবং সাথে প্রভুর বাহন গরুড় পক্ষীরও কোষ্ঠী পাথরের বিগ্রহ রয়েছে । যে সুসজ্জিত রথে এই তিন দেবতাকে এখন বসানো হয় সেটি সূচনা কালের রথ না হলেও রথটি বহুদিনের পুরানো। প্রায় ৩০ ফুট উচ্চ এবং প্রায় ১৬-১৭ ফুর দৈর্ঘ্যা বিশিষ্ট রথটি শাল, সেগুন ও নিম কাঠ দিয়ে তৈরি বলে ।
লোক কথা অনুযায়ী আনুমানিক ৫০০ বছররেও বেশী সময় আগে মালাধর বসুর পৌত্র লক্ষ্মীকান্ত বসু কুলীনগ্রামে স্বপরিবারে এই জগন্নাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।তিনি বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পরে কুলীনগ্রামে শুরু হয়েছিল রথযাত্রা উৎসব পালন।
রথের দিন কুলীনগ্রাম জুড়ে বিশাল মেলা বসে রথের দিন সকাল থেকে সাবেকি রীতি রেওয়াজ মেনে কুলীনগ্রামের জগন্নাথ মন্দিরে হয় বিশেষ পুজোপাঠ। তবে প্রাচীন রিতী অনুযায়ী এখানকার পুজোয় কাঁঠাল চাই। প্রসাদ হিসেবে জগন্নাথ দেবের জন্য খিচুড়ি ভোগ, বলরাম দেবের জন্য অন্নভোগ ও সুভদ্রাদেবীর জন্য পায়েস ভোগ রান্না করা হয়। পূজোপাঠ শেষে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ মন্দির থেকে বাইরে বার করা হয়। প্রথম রথের চার পাশে বিগ্রহগুলি সাতবার ঘোরানো হয়।এর পর রথের সবথেকে উঁচু ধাপে বসানো হয় বিগ্রহ গুলিকে। রথে বিগ্রহগুলি বসানোর পর আবার পুজোপাঠ হয়। তার পর রথে ওঠেন প্রধান পুজারি।রথ টানার জন্য দুটি দড়ি রথে বাঁধা হয়। রথের দিন বিকালে রথ টেনে নিয়ে যাওয়া হয় কুলীন গ্রামের রথ তলায়। এই গ্রামের রঘুনাথ জিউ এর মন্দির জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি বলে পরিচিত। প্রধান পুরোহিত এবং সহযোগী পুরোহীত গণ রথ থেকে তিন দেবতার বিগ্রহ নামিয়ে রঘুনাথ জিউয়ের মন্দিরে রেখে আসেন।উল্টোরথেরদিন ঠিক একই ভাবে তিন দেবতার বিগ্রহ ফের জগন্নাথ মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights