শিলাবতী নদীর তীরে অবস্থিত গড়বেতা মেদিনীপুরের শহর। । বাংলায ভাষায় গড় শব্দের অর্থ নালা বা খাল। পূর্বের গড়বেতা শহরের সীমানা একটি ছোট খাল দ্বারা ঘিরে ছিল। গড়বেতা এছাড়াও গড়হবেতা হিসাবে বানান করা যেতে পারে।ইতিহাস কি বলে কোন রাজার গড় ছিলো? আজকের গড়বেতা ও বগড়ী অঞ্চল অতীতে খ্যাত ছিল বকদ্বীপ নামে ।শিলাবতী নদীর জল এবং ঝড়ো হাওয়া শত শত বছর ধরে মাকরা পাথরের নদী খাত একটু একটু করে ক্ষয় করতে করতে আজ এখানে অসাধারণ প্রাকৃতিক গুহার সৃষ্টি করেছে।আদর করে একে বলা হয়- Grand Canyon of Bengal বলে।দৈত্য বকাসুর এরকমই একটি গুহায় থাকতেন।তখন থেকেই এই জায়গার নাম ছিল বকদ্বীপ। মহাভারতের যুগে অনার্যদের বাস ছিল জঙ্গলাকীর্ন এই প্রাচীন জনপদে। । রাক্ষসরাজ বকাসুর ছিলেন এই জনপদের রাজ। ভীমের হাতে এই বকাসুর নিহত হয়েছিলেন । সেই সময় পঞ্চপান্ডব ছদ্মবেশে একাচক্রনগরে বসবাস করতেন , এই একাচক্র নগর আজকের একাড়িয়া গ্রাম। গড়বেতা ও বগড়ী পরগনাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন গ্রন্হ লিখেগেছেন। অনেক মতে হিড়ম্ব রাক্ষস বাস করতেন হিড়ম্বকবনে যেখানে হিড়ম্বকে বধ করে হিড়িম্বাকে বিবাহ করেন। হিড়িড়গেড়্যা জঙ্গল সেদিনের হিড়ম্বক বন। এখানে প্রাচীন মন্দির দেখতে পাওয়া, মা সর্ব্বমঙ্গলার মন্দির। এখানে প্রতিদিন অন্নভোগ রান্না হয়। আছে দ্বাদশ সিবালয় মন্দির। বগড়ীর মাইতা গ্রামে কৃষ্ণ রাইজীর মন্দির, যে মন্দির দর্শনে এসেছিলেন মা সারদা।অবিভক্ত মেদিনীপুরকে নানান রাজা ও জমিদার বংশ শাসন করতেন। এর মধ্যে বগড়ি রাজবংশ ছিল অন্যতম ছিলেন। আর এই বগড়িদের শাসন অ ছিল গড়বেতায়। গড়বেতা ছিল রাজ্যের রাজধানী। পরে যা গোয়ালতোেড় অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়। বগড়ি শব্দটি বকডিহি থেকে এসেছে বলে অনেকের অনুমান। বকডিহি প্রাচীন গ্রন্থে বকদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল।মল্লভূমের রাজধানী বিষ্ণুপুর অবস্থিত গড়বেতার ২৩ কিমিট দূরে । সম্ভবত রাজা শূরমল্ল (৭৭৫-৭৯৫ খ্রিস্টাব্দ) মেদিনীপুরের এই বগড়ি রাজ্য অধিকার করেন। চোদ্দ শতকের শেষে বা পনের শতকের গোড়ায় জনৈক রাজপুত গজপতি সিংহ এই এলাকা জয় করে বগড়ি রাজ্য আবার করেন। তাঁর দুই ছেলে গড়বেতা ও গোয়ালতোড় এলাকায় নিজের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার পর বগড়ি রাজ্য বলে কিছু থাকে না। তবে বগড়ি কৃষ্ণনগর গ্রামে রাজাদের কুলদেবতা কৃষ্ণরায়জীউয়ের মন্দির এখন মূল আকর্ষণ।তবে কেউ কেউ বলেন , এখানকার বনে প্রচুর বেতগাছ পাওয়া যেত, বলে এই জায়গার নাম গড়বেতা | অনেকে বলেন কুমার গুপ্তের রাজত্বকালে বেত্রবর্মা এখানকার রাজা ছিলেন | এই রাজার তৈরি গড় ই এখানে ছিল।বেত্র রাজার গড়- গড়বেতা। সে অনুসারে এই জায়গার নাম গড়বেতা | তবে আগের সেই অরণ্যের গভীরতা নেই | শিলাবতীর তীর ভেঙ্গে ভেঙ্গে নিচ্ছে নব নব রূপ | তবে এলাকার প্রাচীন নাম যে বেতা তা ১৭৭৯ খৃষ্টাব্দে অঙ্কিত সুপ্রসিদ্ধ রেনেলের এই অঞ্চলের যে মানচিত্র রয়েছে তা থেকে পাওয়া যায়। গড়বেতার মূল মন্দির জাগ্রত দেবী সর্বমঙ্গলার। মন্দিরের অদুরেই শিলাবতী নদী । অনেকে বলেন মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মহারাজা বিক্রমাদিত্য। রাজা দেবীর স্বপ্ন পেয়ে এখানে এসে তালবেতাল সিদ্ধিলাভ করেন। তবে কিছু মানুষের দাবী,মন্দির নিজেই মাটি থেকে ফুঁড়ে বের হয় । অনেকের মতে বগড়ির রাজা গজপতি সিংহই এই মন্দিরের নির্মাতা। মন্দিরটির প্রথমে নাটন্দিরের অংশ ছিল না বলেই অনুমান। অর্থাৎ প্রথমে জগমোহন সহ মূলমন্দির (বিমান) অংশটুকু নির্মিত হয়েছিল। পরে নাটমন্দির নির্মিত হয়। মন্দিরটি মাকড়া পাথরের তৈরি । ওড়িশীর রেখ দেউল রীতির নিদর্শন এই মন্দিরটি ।মূল মন্দির (বিমান) ত্রিরথ রেখ। এর উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট যার দৈর্ঘ ১৭ফুট ৩ ইঞ্চি ও প্রস্থ ১৫ ফুট ৯ ইঞ্চি। । গর্ভগৃহ অন্ধকার। মূল মন্দিরের সাথে জগমোহন অংশকে যুক্ত করেছে একটি ছোট্ট অন্তরাল। জগমোহনটি দৈর্ঘ্য ৩৪ ফুট ১ ইঞ্চি ও প্রস্থে ২৪ ফুট ৭ইঞ্চি। উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট। জগমোহনটি পীঢ় রীতির। উপরের ছাদ তিনটি ধাপে বিভক্ত। এর বাইরের চারপাশে চৌষট্টি যোগিনী ও সর্পকন্যা খোদিত রয়েছে। রয়েছে অন্যান্য অলংকরণ। জগমোহনের ভেতরে রয়েছে চতুর্ভুজা আদ্যামাতার মূর্তি। মন্দিরে কোন নির্মাণ কালের উল্লেখ নেই। তবে স্থাপত্য দেখে বোঝা যায় এটি ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত। জগমোহনের সামনে ছোট্ট যোগমণ্ডপ । গর্ভগৃহ থেকে যোগমণ্ডপের ছাদ লহরাযুক্ত। পরের অংশ নাটমন্দিরটি চারচালা। পরবর্তীকালে নির্মিত। চোদ্দটি দরজা রয়েছে।এই অঞ্চল বিখ্যাত এখানকার স্থানীয় রাজা দূর্জন সিংহ এবং অচল সিংহের জন্য। ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে করা এঁদের লড়াই ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে চুয়াড় বিদ্রোহ নামে।চুয়াড় নাম থেকেই বোঝা যায় সমাজের একেবারে নিম্নবর্গীও লোকেরা এই বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।তবে এরা কি ছিলেন তাই নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলে রাজা, কেউ বলে লুটেরা, আবার অনেকে বলে সন্ন্যাসী।