বিশ্বরূপ দে ( পঞ্চসায়র শিক্ষা নিকেতন)
ওর নাম সিদ্ধেশ্বর চাটুজ্জ্যে৷ আমরা ওকে স্যাঁদা বলে ডাকি৷ সিদ্ধেশ্বর নামটা ওর জন্য যথার্থ কারণ সব কিছুতেই ও সিদ্ধ হয়েছে। সে হিমালয়ে তপস্যা থেকে শুরু করে ভিন গ্রহে ভ্রমণ যাই হোক না কেন। যদিও সে গল্পগুলো যা স্যাঁদার ভাষায় ঘটনায় সেগুলো ওর নিজের মন গড়া কাহিনী তা আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না।
সকুমার রায়ের দাশু ওরফে দাশরথী ও আমাদের স্যাঁদা ওরফে সিদ্ধেশ্বরের মধ্যে অনেক কিছুর-ই মিল আছে৷ যেমন দাশু অঙ্কে ভালো, স্যাঁদাও অঙ্কে ভালো৷ দাশুকেও কেউ চেনে না এমন কেউ হতেই পারে না, স্যাঁদাকেও কেউ চেনে না তাও অসম্ভব৷ দাশু আর স্যাঁদার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো মিল হল দুজনেই ক্ষ্যাপাটে ধরণের৷
চেহারায় দাশুর সাথে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। দাশুর চেহারা ‘ক্ষীণ দেহে, খর্বকায় মুন্ড তাহে ভারী/ জশোরের কই যেন নর মূর্তি ধারি’। কিন্তু আমাদের স্যাঁদা রোগা হলেও দাশুর মতো কঙ্কালসার চেহারা নয়৷ স্যাঁদার চোখ দুটোও গোল গোল নয়, কানও খুব বড়ো নয়। ওর সামনের দুটো দাঁত উঁচু , ঠিক যেন খরগোশের মতো৷
পড়াশোনায় ও বেশ ভালো। খেলাধূলাতেও সে ভালো। ব্যাড মিন্টন খেলায় স্যাঁদা স্কুলের সেরা। স্যাঁদা অন্যান্য খেলা সম্মন্ধে ভালো করে জানা থাকলেও ফুটবল সম্মন্ধে ওর বেশি কিছু জানে না তা ওর কথাতেই বোঝা যায়৷ যেমন ও বলে ফুটবলের ম্যাচে ফাউল হলে ইয়োলো কার্ড আর ফুটবলে হাত দিলে বা প্যানাল্টি হলে রেড কার্ড দেখায় ৷ আমরা যত বলি কোনো প্লেয়ারকে ল্যাং মেরে ল্যাংড়া আম খাওয়ালে মানে ফেলে দিলে রেড কার্ড দেখায়, তখন সেই প্লেয়ার ডিসকলিফাই হয় যায়। কিন্তু স্যাঁদা মানতে নারাজ। ও বলে, ‘বাঃ রে, যদি প্লেয়ার ডিসকলিফাই-ই হয়ে যায় তখন খেলবে কে শুনি?’ তখন যদি বলি, ‘কেন বাকি দশ জন খেলবে৷’ স্যাঁদা সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে বলে উঠবে, ‘ফুটবল কি দশ জন খেলে, ফুটবল তো খেলে এগারো জন।’ তার উত্তরে আর কী বলা যায়।
এবার যদি এই ছেলে ফুটবলে আমাদের দলে থাকে তবে আমাদের দলের যে শোচনীয় অবস্থা হবে তা আমার বুঝতে অসুবিধে হয় নি। কিন্তু বাধ্য হয়ে ওকে একবার আমাদের দলে নিতে হয়েছিল। তখন ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছে আদর্শ শিক্ষা নিকেতন বনাম পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠ। পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের ফুটবল খেলায় খুব নাম। শুনে এসেছি এই স্কুলের কাছে আমাদের আদর্শ শিক্ষা নিকেতন নয় বারের মধ্যে ছয় বার হেরেছে, দুই বার ড্র হয়েছে আর একবার কোনভাবে ২-১ গোলে জিতে গেছে। এবার আমাদের পালা।
আমাদের দলে আছে জগাই, সৌরভ, যতীন, দীনেশ, জ্যোতি, মৃন্ময়, জীবন, অখিল, গিরিশ আর আমি। এবার আর একজন। কিন্তু বাকি আর কেউ খেলায় ততটা ভালো নয়। আমার মাথায় এল স্যাঁদার কথা৷ স্যাঁদা বেশ জোড়ে দৌঁড়োয়, তাছাড়া ওর বল কাটিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ওর আছে৷ দলের বাকিদের বললাম সেই কথা। সকলে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘না না, কিছুতেই না।’ সবাই জানে স্যাঁদা ভালো খেলে,কিন্তু ফুটবলের সাধারণ জ্ঞান নেই৷ আমি সকলকে শান্তনা দিয়ে বললাম, ‘আমি ওকে নিয়ম শিখিয়ে দেব।’ বাকিরা মনে মনে স্যাঁদাকে না চাইলেও আমি ক্যাপ্টেন হওয়ায় আমার কথার উপর কেউ কিছু বলল না।
দুই সপ্তাহ বাদে ম্যাচ। আমি ওকে ফুটবলের নিয়মের একট লিস্ট বানিয়ে দিয়ে বললাম, ‘এগুলো ভালো করে দেখে রাখ স্যাঁদা। আমাদের জিততেই হবে, মান সম্মানের ব্যাপার। হেরে গেলে কাউকে মুখ দেখাতে পারব না। কিছু করতে ভাই। তোর উপর আমার ভরসা আছে।’ এই কথাগুলো শুনে যা প্রতিক্রিয়া আশা করা যায় স্যাঁদার সে প্রতিক্রিয়া তো হলই না বরং নিয়মের লিস্টটা নিয়ে হে হে করে হেসে নিজের জায়গায় চলে গেল।
সেই দিন টিফিন ব্রেকে স্যাঁদা টিফিন না খেয়ে সারা টিফিন জুড়ে ফুটবলের নিয়মগুলো জোরে জোরে পড়া মুখস্থ করার মতো শব্দ করে পড়ল। সেদিন বিকেল থেকেই আমাদের প্রেকটিস শুরু। স্যাঁদাকে প্রথম দিন ডাকলাম না। ওর নিয়মগুলো আগে জানার দরকার। তাই প্রথম কদিন ওকে প্রেকটিসে আসতে হবে না। পরের দিনও ও গোটা টিফিন জুড়ে পড়ে গেল নিয়মগুলো। আমার মায়া হল স্যাঁদার উপর। ছেলেটা না খেয়ে আমাদের দলের জন্য পরিশ্রম করছে। পরের দিনও ও তেমনটাই করছিল। সেদিন ওকে আমার ভাগের টিফিন দিয়ে বললাম, ‘তুই আমাদের দলের জন্য না খেয়ে এগুলো মুখস্থ করে যাচ্ছিস। তুই আমার টিফিন খা। আর একটা কথা তুই কাল থেকে প্রেকটিসে আসবি।’
টিফিন না খাওয়ায় সেদিন ক্লাসে খুব খিদে পেয়ে যায়। সে সময় আমার চোখ গেল স্যাঁদার দিকে৷ দেখি স্যাঁদা লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের টিফিন খাচ্ছে। মানে এই কয়েকদিনও ও এমন ভাবেই লুকিয়ে খেয়েছে। মনে মনে ভাবলাম, ‘ভরা পাত্রে দান করে, নিজের পাত্র খালি রাখলাম।’ স্যাঁদার টিফিন দেখে খুব লোভ লাগছিল। কিন্তু কিছু করার নেই। ওর কাছে এখন চাইতেও পারব না। নালিশ করতেই পারতাম। কিন্তু ওসব আমার ধাতে সয় না।
সেদিন বিকেলে প্রেকটিসে স্যাঁদা এল না৷ ভাবলাম ওর খাবারে লোভ দেওয়ার জন্য ওর ইয়ে মানে পেট-ফেট খারাপ হল নাকি? হয়ে থাকলে খুব বিপদ। আমার জন্যই আমাদের দলের ভয়ঙ্কর বিপদ হবে। সেদিন অপেক্ষা করেও স্যাঁদা এল না। বাকিরা জিজ্ঞেস করল স্যাঁদার কথা। কিছু বলতে পারলাম না। পরেরদিন ও স্কুলে কিংবা প্রেকটিসে কোথাও এল না। আমার ভয় হল। ওর কি সত্যি সত্যি শরীর খারাপ হল? তাহলে তো বিপদের শেষ নেই।
তারপরের দিন স্যাঁদা স্কুলে এল। আমার ধরেও প্রাণ ফিরে এল। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন আসিস নি স্কুলে আর প্রেকটিসে?’ ও শুধু বলল, ‘এমনি৷’ ও কখনও এমনি এমনি ছুটি নেয় না। পরীক্ষার আগের হাফ ছুটির দিন কেও না এলেও স্যাঁদা আসবেই৷ আজও সারা টিফিন জুড়ে ও ফুটবলের নিয়মগুলি পড়ে গেল, তারপর ক্লাসের মাঝে নিজের টিফিন সমাপ্ত করল।
ম্যাচের দিন এসে গেল। এই কয়দিনের মধ্যে স্যাঁদা শেষ দুই দিন ছাড়া আর বাকি এক দিনও প্রেকটিসে আসে নি। না আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তরই দেয় নি। এখন আমাদের জেতার কোনো সুযোগই নেই। ওদের দলের ছেলেগুলোর চেহারা দেখলেই ভয় করে। এক ঘুসিতেই আমাদের কুপকাত করে দেবে। তার উপর স্যাঁদার ভালো করে প্রেকটিস হয় নি।
ম্যাচ শুরুর আগে সৌরভ বলল- ‘রেফারিকে কচুরী জিলিপি খাইয়ে হাত করে নিলে হত।’
দীনেশ বলল, ‘তোর মাথা এতো দেরী করে খোলে কেন রে?’
সৌরভ প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, ‘তোর যখন মাথা সব সময় খোলা থাকে তাহলে তুই আগে এই বুদ্ধিটা দিলি না কেন?’
দুজনের কথার মাঝে যতীন বাঁধা দিয়ে বলল, ‘তোরা খাওয়ানোর টাকা পেতিস কোত্থেকে?’
এবার স্যাঁদা বলে উঠল, ‘কেন, তোরা আছিস কী করতে?’
আমি বললাম, ‘এখন যখন আর খাওয়ানো হয় নি, তখন আর কিছু উপায় নেই৷ আমাদের খেলেই জিততে হবে।’
আমি আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের দলের সবাইকে সবকিছু ভালো করে বুঝিয়ে দিলাম। ম্যাচ শুরু হল আদর্শ শিক্ষা নিকেতন বনাম পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠ। আমাদের নীল আর পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের ছেলেদের লাল জার্সি। কমেন্ট্রেটার কমেন্ট্রি করছে। স্ট্যাডিয়ামের দুই পাশের দর্শকবৃন্দরা খেলা দেখছে আর চিয়ার আপ করছে।
প্রথমে পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের ছেলেদের পায়ে বল। আমাদের গোলপোস্টের কাছে বল চলে এসেছে। তখনই গিরিশ পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের দলের একটা ছেলের পায়ের থেকে বল কাটিয়ে নিয়ে জীবনকে পাস করল। জীবন প্রাণপণে ছুটে সোজা পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের গোলপোস্টের কাছে এসে সেন্টার ফরয়ার্ড মৃন্ময়কে পাস দিল। আর মৃন্ময় কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে বলে কিক করল। বল গোলে ঢুকল আর সঙ্গে সঙ্গে এক অংশ দর্শক গোল বলে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল।
এবারে যেন পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের ছেলেরা ক্ষেপে উঠল। ওদের দলের ছেলেদের পায়ে বল। ওদের খেলার টেকনিক পাস করে। মানে পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের একজনের পায়ে বল আর আমাদের অর্থাৎ আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের লক্ষ্য সেই বলের দিকে এমন সময় সে আরেকজনকে পাস করল সেই দিকে লক্ষ্য স্থির করার সাথে সাথেই আরেকজনকে পাশ। এর সাথে সাথেই আমাদের গোলকিপার দীনেশের পাশ দিয়ে বল গোলপোস্টের ভিতর চলে গেল আর পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের প্রথম গোল। অন্য অংশ দর্শক উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল।
এর সাথে সাথে কুড়ি মিনিটে এক এক গোলে সমানে আছে আদর্শ শিক্ষা নিকেতন আর পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠ। হাফ টাইমের মধ্যে আরো দুটো গোল করে দিল পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের।
আমাদের শোচনীয় অবস্থা। আমাদের মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু স্যাঁদা খোস মেজাজেই আছে। দলের সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে। আমাদের থেকে পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের ছেলেদের পায়েই বল বেশিক্ষণ থাকছে। ওই স্কুল জেতার জন্য স্টুডেন্টদের একজন বিখ্যাত ফুটবল কোচ অশোক তালুকদারকে দিয়ে খেলা শিখিয়েছে। আর যাতে হারার সুযোগ শতকরার এক ভাগও না থাকে তাই রেফারিকে মুখরোচক কোনো কিছু খাইয়েছে। সেটা বুঝলাম হাফ টাইমের পর।
আমাদের গোলের সামনে বল। কিন্তু এবার আমরা ফ্রমে আছি। আমরা আটকানোর পুরো চেষ্টা করলাম। আর তখনই পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের একটা ছেলের হাতে বল লাগল। আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম পেনাল্টি। কিন্তু রেফারি ঘোষণা করল পেনাল্টি হয় নি। আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের ছেলেরা প্রতিবাদ জানালাম। কিন্তু কোনো ফল হল না। আমার কাছে সৌরভ এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘ওরা রেফারিকে সত্যিই কচুরী জিলিপি খাইয়েছে।’ কোনো উত্তর দিলাম না। মুখ গোমড়া করে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি সবাই আর সাথে সাথে পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের চার নম্বর গোল।
এই হাফ টাইমের পর আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের হারার সব রাস্তা খুলে গেল। একে ওদের গোল অনেক বেশি আমাদের থেকে তার উপর রেফারিকে হাত করে নিয়েছে আর তার উপর কী হল তা শুনতে গেলে একটা ঘটনা বলতে হয়। পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের চার নম্বর গোলের পর আবার খেলা শুরু হল। আমাদের গোলপোস্টের দিকে বল নিয়ে ছুটে আসছে ওদের এই বছরের ক্যাপ্টেন ও সেরা খেলয়াড় অঞ্জন। অঞ্জন দৌঁড়চ্ছে এমন সময় স্যাঁদা পা বাড়িয়ে ল্যাঙ মেরে ফেলে দিল ওকে। মুখ থুবড়ে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল অঞ্জন।
অঞ্জনের সামনের দিকে দুটো দাঁত পড়ে গেল। ওকে স্ট্রেচারে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। ওর জায়গায় আরেকজন এল। আর স্যাঁদার যা হওয়ার তাই হল। রেফারি ওকে রেড কার্ড দেখালো। ও এখন রেড কার্ডের মানে জানে। হি হি করে হেসে ও মাঠ ছেড়ে চলে গেল৷ ডিসকলিফাই হয়ে যাওয়ার পরেও হাসছে। সত্যি আমি স্যাঁদাকে নিয়ে ভুল করেছি। নিজের সিদ্ধান্তের উপর রাগ হল। স্যাঁদা যাওয়ার পর ওকে আর স্টেডিয়ামের ধারে-কাছে দেখলাম না।
স্যাঁদা যাওয়ার পর আমরা দশ জন আর এর মধ্যে পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের আরেকটা গোল হয়ে গেল। আশি মিনিটে আদর্শ শিক্ষা নিকেতন পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের কাছে এক পাঁচে পিছিয়ে। আর দশ মিনিটে আমাদের জেতা অসম্ভব। খুব খারাপ লাগছে। ওরা আর আমাদের গোলের দিকে এগোচ্ছে না। কিন্তু আমাদের গোল করার থেকে আটকাচ্ছে।
আমরা পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের গোলপোস্টের সামনে। ওদের ছেলেদের পায়ে বল। ও আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের গোলপোস্টের দিকে বল মারার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ মাঠে কী একটা এসে পড়ল। জিনিসটা খুব ছোটো। স্টেডিয়াম খুব বেশি উচুঁ না হওয়ায় বাইরে দিয়ে স্বজোড়ে কিছু ছুড়লে সোজা মাঠে এসে পড়বে। জিনিস মাঠে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠ কেঁপে উঠল। পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের ছেলেটা ঘাবড়ে গিয়ে নিজেদের গোলপোস্টের দিকে বলে কিক করল। এক অংশ দর্শক এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। তারা এবার উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল।
এখনও আমাদের জেতার সুযোগ নেই। ড্র করতে গেলে আর পাঁচ মিনিটে চাই তিন গোল। খেলা চলছে আর এমন সময় হঠাৎ-ই আমাদের সবার নজরে পড়ল স্টেডিয়ামের বাইরে থেকে পনেরোটা আতশ বাজি মাঠের দিকে ধেয়ে আসছে। খেলা থামিয়ে আমার এদিকে-ওদিকে ছুটছি। রেফারি ছুটতে ছুটতে পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের একটা ছেলের কলে উঠে পড়ল। ছোটাছুটি করতে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। কেউ বা হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। দর্শকদের মধ্যে হইচই শুরু হল। অনেক ছোটাছুটির পর আমরা স্টেডিয়ামের দর্শকদের স্থানে উঠলাম। আতশ বাজিগুলো মাঠেই ফাটল।
কারোও কোনো ক্ষতি হয় নি। আমরা সবাই হতচকিত অবস্থায় কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। যখন হুশ এল তখন ঘোষণা করা হল, ‘আতশ বাজি আক্রমনের দরুন আজকের ম্যাচ ক্যানসেল করা হল। আজকের ম্যাচের কোনো বিজেতা নেই।’
আমাদের মানে দুই স্কুলের ছাত্রদের শান্তনা পুরষ্কার হিসেবে একটা করে মিষ্টির প্যাকেট আর যারা খেলেছে তাদের জন্য একটা মেডেল। আমরা হই-হই করে উঠলাম। হারার থেকে ম্যাচ ক্যান্সেল হওয়া ভালো। পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের ছেলেরা মুখ ব্যাজার করে বসে আছে। এই নিয়ে চার বছর ওরা জিততে পারল না। ওদের রেফারিকে ঘুষ খাওয়ানো জলে গেল।
শান্তনা পুরষ্কার দেওয়ার সময়ই আবার স্যাঁদাকে দেখলাম। এতক্ষণ ওকে স্টেডিয়ামের কোথাও দেখি নি। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এতক্ষণ কী করছিলি?’ স্যাঁদা বলল, ‘স্টেডিয়ামে ছিলাম উপরের দিকে।’ তারপর হি হি করে হেসে ফেলল। তখনই সবাই বুঝলাম ও মিথ্যে কথা বলছে। গিরিশ বলল, ‘তোর মিথ্যে বলা ধরা পড়ে যায়। সত্যি কথা বল কোথায় ছিলি?’
ওর কাছে যা শুনলাম তাতে আমরা সকলে বিস্মিত হলাম। ও ইচ্ছে করেই পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠের ক্যাপ্টেন অঞ্জনকে ল্যাঙ মেরেছে যাতে পঞ্চপুকুর বিদ্যাপীঠ একটু দুর্বল হয় আর ও নিজের পরিকল্পনা মতো কাজ করতে পারে। স্যাঁদার পরিকল্পনা মতো ওদের পাড়ার দীপককে ঘুষ দিয়ে মানে চপ-কাটলেট খাইয়ে হাত করেছে স্যাঁদা, কারণ ওর বাবার বাজির দোকান। দীপককে হাত করার জন্য ও একদিন স্কুলে আসে নি। সবরকম বাজি আছে ওর বাবার দোকানে। ও তা থেকে কিছু চকলেট বোম্ব আর এক বাক্স আতশ বাজি হাত সাফাই করেছে। দীপকের ছোঁড়ার টিপও খুব ভালো। দীপকই চকলেট বোম্বটা ছুঁড়েছে আর আতশ বাজিগুলো মাঠের দিকে লক্ষ্য করে ফাটিয়েছে যাতে ম্যাচ ক্যান্সেল করা সম্ভব হয়। ওর নিজেরও ওপর ভরসা ছিল ম্যাচ ড্র হবেই, তাই ও প্রেকটিসে বেশি আসে নি।
আমি বললাম, ‘যদি কারো লেগে যেত তখন কী হত?’
জ্যোতি বলল, ‘যাই হোক স্যাঁদার জন্যই আমাদের হারা ম্যাচ ড্র হল।’
সবাই মিলে স্যাঁদাকে তুলে উল্লাসে চেচিয়ে উঠে বললাম, ‘বি চিয়ার্স ফর আদর্শ শিক্ষা নিকেতন, হিপ হিপ হুররে। বি চিয়ার্স ফর স্যাঁদা, হিপ হিপ হুররে।’