google-site-verification=r3lYzE3jI5XC8igrXRKdm9HAWALrzmx6coPmyeHNww4
Spread the love

মিঠুন মাহাত

টুসুয়েই বা কি? আর ইহার মধ‍্যে কেমন বিজ্ঞানেই লুকিয়ে আছে তা বুঝতে হলে বুঝতে হবে যুগ যুগ ধরে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ভাবে মানুষের করে আসা ধানের কৃষিকে এবং একজন মহিলার ছোট থেকে বড় হওয়া, বিয়ে হওয়া, শ্বশুরবাড়ি যাওয়া, বাচ্চার জন্ম দেওয়া এবং বার্ধক‍্যলাভের জীবন পর্যন্ত।

রাঢ় সংস্কৃতি হচ্ছে, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি, আর এই সংস্কৃতি পুরোটাই বিজ্ঞানভিত্তিক। আর এই সংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ পরব হল এই টুসু পরব।
টুসু অর্থাৎ টুই+সু। কুড়মালিতে টুই শব্দের অর্থ হল সর্বোচ্চ(উর্ধস্থান) এবং সু তে সুরুজ( সূর্য)। অর্থাৎ প্রকৃতির মহাশক্তির সর্বোচ্চে অবস্থান। আর এই প্রকৃতির মহাশক্তি ছাড়া মানবজীবন অচল।আর এই প্রকৃতির মহাশক্তির কারণেই সর্বোচ্চে অবস্থানের কারণে কৃষিকাজের মাধ‍্যমে ফসলে জীবনীশক্তি সম্মাহিত হয় এবং ফসল পূর্ণতা পায়। আমাদের ফসলে থাকা ঐ সৃজনশীল জীবনী শক্তিকেই টুসু বলে।

এক সড়পে দুই সড়পে, তিন সড়পে লক চলে।
হামার টুসু মাঝে চলে, বিন বাতাসে গা ডলে।

এই জগতে তিনটি গুন আছে। যা হল সত‍্য, রজ, তম।টুসু মাঝের গুণ রজতে চলে। এই রজগুণের কারণেই পৃথিবীর এতবড় সৃষ্টি চলছে। আর এই রজগুণের কারণেই ধানের একটি শস‍্য থেকে ধানের গাছ, আর এই ধান গাছে ধানের শস‍্য ফলে। তা থেকে আমাদের সারাবছর ধরে জীবনধারণ হয়।
ধানের কৃষিকেন্দ্রিক কুড়মালি সংস্কৃতির বার মাসে তের পরবের শেষ পরবটিই হল এই টুসু পরব। যা কুড়মালি ক‍্যালেণ্ডারের শেষদিন অর্থাৎ পৌষ সংক্রান্তিতে পালন করা হয়।
টুসু আসলে ধানের শস‍্য ছাড়া আর কিছু নয়। এই ধান যখন খেতে থাকে তখন তা ধানীমাঞ, আবার আঘন সাঁকরাইত দিনে ক্ষেত থেকে খামারে এনে তা হয় ডিনিমাঞ(ঠাকুরমাঞ),আর এই ধানকেই আঘন সাঁকরাইত দিনে কন‍্যা হিসাবে পাতালে তা হয় টুসু।
আর এই টুসুকেই পৌষ সংক্রান্তির দিন বিয়ে দেওয়া হয় অর্থাৎ অঙ্কুরোদগমের জন‍্য প্রতীকিভাবে জলে দেওয়া।
এই ধানের শস‍্যকেই ধান চাষের একেবারে শুরুতেই অর্থাৎ চারা তৈরীর আগে রহইন দিনে ধানপুনহা(বীজপুনহা) করা হয়। যা ধানের বীজ ফেলার শুভ সূচনা হিসাবেই পরিচিত।আর এইসময়েই এটা করার কারন হচ্ছে এসময় যদি ধানের বীজ ফেলা হয় তা হবে ধূলাবতরে ফেলা। আর এর থেকে ধানের যে চারা তৈরী হবে তা হবে সর্বোৎকৃষ্ট। যা পুরোপুরী বৈজ্ঞানিক। আর এই ধূলাবতরে অনেকেই ধানের বীজ না ফেলতে পারলে অনেকে মাহারসে, আবার মাহারসে না হলে আছড়াও ফেলেন যেগুলি ধানের বীজ ফেলার আদিম যুগ ধরে চলে আশা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।আবার ধানের চারা যখন হয়ে যায়, তা খেতে রোপণ করার আগে পাঁচটা আঁটি দিয়ে ক্ষেতের উত্তর পূর্ব কোণে বৃষ্টির কামনায় বান নামহায়(পাঁচাটি)। কারণ এই উত্তর পূর্ব কোণ থেকেই লাগাতার ঝড়বৃষ্টির মেঘ ওঠে।এরপর ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে ধান গাছে যেই শিস নেওয়ার আগে ধান গাছ মেচায়(ধানের শিস নেওয়ার আগের অবস্থা) সেসময়েই যাতে কীট পতঙ্গরা ধান গাছের ক্ষতি না করতে পারে সেজন‍্য ক্ষেতে বুঁয়ান(সিরুয়াল) ডাল গাড়া হয়। এইসময় যদি ক্ষতি হয়ে যায়, তা হলে তা হবে ধান চাষের ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি।
এই টুসু গীতটা একটু লক্ষ‍্য করুন
পানিই হেলা,পানিই খেলা,
পানিই তহরাক কন আউহন।
ভালঅ কোরি ভাভি দেখা,
পানিই সসুরঘার আহন।
অর্থাৎ পানি শ্বশুরঘর ছাড়া সৃজন সম্ভব নয়। এই সৃজনের জন‍্যই টুসুকে(ধান) মকরদিনে জলে(বিয়ে) দেওয়া হয়। এরপর মাঘের প্রথম দিন যেদিন শ্বশুরঘরের প্রথম দিন সেই আখাইন দিনে হাল পুনহা (হার পুনহা) করা হয়। আর এই দিনেই আড়াই পাক হাল চালিয়ে কৃষির সূচনা করা হয়। এরপর যদি বৃষ্টি হয় তাহলে বিনা বাধাতেই ধানের চারা তৈরীর জন‍্য জমি তৈরী করতে পারবে। এইজন‍্য এইদিনকেই কুড়মালি বছরের প্রথম দিন ধরা হয়। আর এই দিন থেকে আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের অষ্টমী দিনটা ধরলে অর্থাৎ যেদিন খেতকে জাগানো হয়, সেইদিনটা দেখবেন নমাস হচ্ছে। গর্ভবতী মহিলাকে নমাসের সময় যেমন খাওয়ানো হয় ঠিক সেইরকম কারণের জন‍্য ঐসময় খেতের ধান গাছকে জাগানো হয়‌।
এরপর এই ধানকেই আঘন সাঁকরাইত দিনে ধানের কৃষির শেষ হিসাবে ক্ষেতে রাখা ধানের আঁটিকে ডিনিমাঞ করে খামারে নিয়ে আনা হয়। কোন মহিলার যদি শেষ বয়স হয় তাহলে তাকে আমরা ডিনিমাঞ, দুধুমাঞ, ঠাকুরমা প্রভৃতি বলে সম্মান দি, সেরকম অনুরূপ কৃষির শেষ স্মৃতি সম্পর্কিত ধানকে ডিনিমাঞ বলা হয়।আর ঐদিনেই নতুন ধানের শস‍্যকে নিয়ে টুসু পাতানো হয়।
আর পুরো একমাস বাড়িতে কন‍্যাসম লালন পালন করে মকর সংক্রান্তির দিন টুসুকে তার শ্বশুরঘরে যাওয়ার ব‍্যবস্থা করে দেয়।
কুড়মালি বছরের প্রথম দিন আখান দিন থেকে শেষদিন মকরদিন পর্যন্ত আপনারা লক্ষ‍্য করুন
ধানের কৃষি সম্বন্ধিত রাঢ় অঞ্চলে যেসকল নেগনীতি, আচার আচরণ তার মধ‍্যে কতসুন্দর বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে এবং তারসঙ্গে এক মহিলার জন্ম থেকে বার্ধক‍্য পর্যন্ত জীবনের অপরূপ মেলবন্ধন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights