আঁটপুরের অনবদ্য টেরাকোটা মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু আজ শোনাবো অন্য গল্প।আঁটপুরে বাবুরাম ঘোষের গ্রামের বাড়ি ছিল। ওঁনারা ছিলেন তখন আঁটপুরের জমিদার।বাবুরাম ঘোষ পরবর্তীকালে স্বামী প্রেমানন্দ বলে পরিচিত হন।
২৪ ডিসেম্বরকে মহামানব যীশুর আবির্ভাবের প্রাক-দিবস উপলক্ষে ‘ক্রিসমাস ইভ’ হিসাবে পালন করা হয় সারা বিশ্বে । তবে বাংলাদেশ এই দিনটি তাৎপর্যপূর্ণ, ভারতের ইতিহাসে একটা বিশেষ দিন।
ইতিহাস অনুযায়ী, ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ আগষ্ট কাশীপুর উদ্যানবাটীতে ঠাকুরের দেহত্যাগের পর এইদিন বাবুরামের মা বাবুরামকে আঁটপুরের বাড়িতে ডেকে পাঠান। ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৯শে ডিসেম্বর স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর আট গুরুভাইকে নেমে তারকেশ্বরগামী ট্রেন থেকে হরিপাল রেলওয়ে স্টেশনে নেমেছিলেন। হরিপাল রেল স্টেশন থেকে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর আট গুরুভাই নিয়ে আঁটপুরের পৌছে ছিলেন হেঁটেই ।
১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে নরেন্দ্রনাথের গুরুভাই বাবুরাম ঘোষ এর মা শ্রীমতী মাতঙ্গিনী দেবী নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য গুরুভাই আঁটপুর গ্রামে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। তাঁরা সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৯শে ডিসেম্বর হরিপাল ষ্টেশন থেকে আঁটপুরে যান।
নরেন্দ্রনাথ, বাবুরাম, শরৎ, শশী, তারক, কালী, গঙ্গাধর, নিরঞ্জন ও সারদা কিছুদিন আঁটপুরে থাকেন। আর এই আঁটপুরেই বড়দিনের আগের দিনের সন্ধ্যায় নরেন্দ্রনাথ ও আটজন ধুনি জ্বালিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণের সংকল্প করেন।
১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে ডিসেম্বর (১৩ই পৌষ, ১২৯৩ বঙ্গাব্দ), আঁটপুর। বেশ রাত তারাভরা আকাশ নিচে ধুনি জ্বালিয়ে ধ্যানে নিমগ্ন হয়েছিলেন নয় যুবক। শ্রীরামকৃষ্ণের নয় ভক্ত। ধ্যান শেষ হতেই । শুরু করে ঈশ্বর নিয়ে আলোচনা। সেখানে মূল কথক অবশ্য একজনই। বাকিরা শ্রোতা।
তিনি যীশু খ্রীষ্টের জীবনকথা শোনালেন । অনেকের ত্যাগের মধ্য দিয়ে কী ভাবে খ্রীষ্ট ধর্ম ও খ্রীষ্ট সম্প্রদায় ব্যাপক ভাবে প্রসারিত হয়েছে তা শোনালেন। তিনি বোঝালেন, জগৎ কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করতে হলে ত্যাগই বড় কথা। আর এর প্রথম ধাপ হল সংসারত্যাগ।
ন’জন গুরুভ্রাতা উঠে দাঁড়ালেন, ধুনির অগ্নিশিখাকে সাক্ষী করে সংকল্প করলেন মানুষের স্বার্থে সংসার ত্যাগ করবেন। সন্ন্যাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন নরেন্দ্রনাথ (বিবেকানন্দ), বাবুরাম (প্রেমানন্দ), শরৎ (সারদানন্দ), শশী (রামকৃষ্ণানন্দ), তারক (শিবানন্দ), কালী (অভেদানন্দ), নিরঞ্জন (নিরঞ্জনানন্দ), গঙ্গাধর (অখণ্ডানন্দ) এবং সারদা (ত্রিগুণাতীতানন্দ)।
সেই রাতেই রামকৃষ্ণ মঠ মন্দির প্রতিষ্ঠার বাসনা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আঁটপুরে দীক্ষাগ্রহণ করেন তাঁরা। এবং রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ওই ৮ মহান শিষ্য নতুন নাম নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লেন । উদ্দেশ্য ছিল, একটা মহান বেদান্ত ধর্মের মূল সূত্র পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার, প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা করা শিক্ষা আলো জালিয়ে দিকে দিকে। নতুন নাম ও জড়িয়ে বস্ত্র নিয়েছিলেন সকলেই।
এই মাথায় রেখে আজও প্রতি বছর ২৪ ডিসেম্ব র ‘ধুনি উৎসব’ পালিত হয়ে আসছে বাবুরাম মহারাজের ভিটেতে। অধুনা যা ‘আঁটপুর রামকৃষ্ণ মঠ’ নামে পরিচিত। মহা সমারোহে আজও এই দিনটি বিশেষভাবে পালিত হয়ে আসছে।
এই দিনটি ঘুরতে যাওয়া যায় এই আটপুর গ্রামে ।হুগলি জেলার এক ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র এটি। এই গ্রামে বহু প্রাচীন যুগের নিদর্শন এক শিবমন্দির আছে যেখানে সাধক পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ দেব এসেছিলেন দাবি অনেকের। এছাড়া দুশো বছরেরও আগে অর্থাৎ আঠারো শতকের শেষ দিকে তৈরি রাধাগোবিন্দ জিউয়ের মন্দির,পুরোনো দোলমঞ্চ, চণ্ডীমণ্ডপ অনেক প্রত্নতত্ত্বের ঐতিহ্য বহনকারী স্থান দেখার আছে।
কলকাতার সিদোকানহু ডহর (এসপ্ল্যানেড) থেকে সরকারি এক্সপ্রেস বাসে সরাসরি আঁটপুর দু-ঘণ্টার পথ।মানেকলকাতা থেকেহাওড়া বাইপাস, বেনারস রোড, জগদীশপুর, শিয়াখালা হয়ে আঁটপুর আনুমানিক ৭০ কিলোমিটার পথ।
.