google-site-verification=r3lYzE3jI5XC8igrXRKdm9HAWALrzmx6coPmyeHNww4
Spread the love

           বীরেশ চন্দ্র ঘোষ 

জীবনের বেলা যত গড়িয়ে যায়,স্মৃতি মাঝে মাঝে এক সাথে ভীড় করে,যা মনের মণিকোঠায় সাজানো আছে স্তরে স্তরে। এমনই একটি স্মৃতি আজ ফিরে ফিরে উঁকি দিয়ে চলেছে।
অনেক দিন আগের ঘটনা,তখনকার দিনে গ্রাম বাংলার আর্থ সামাজিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না,বিশেষ করে যাদের ঠিক থাকে না কাজের,ঠিক থাকে না রোজগারের। যেন প্রতিদিন কাজ করাটা ভাগ্যের,বছরে চাষ হয় একবার,কাজ করার খেত কোথায়,ফলে জীবন জীবিকার লড়াই ছিল কঠিন।বাগদি পাড়া,বাউরি পাড়ার পথে চিনেছি দারিদ্র্যতাকে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষাতে ওদের ছেলেরা থাকত আদুল গায়ে।
রোজ অফিস যাওয়ার পথে দেখতে দেখতে যেতাম বাগদি পাড়া,বাউরি পাড়ার মানুষ, ওদের খড় ছাড়া এক চালা ঘর গুলো। রোজ যাওয়া আসার সুবাদে। তমাল,ভোলা,মহাদেব,রবি,জয়দেব,হারাধন,গোপাল সকলের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জ্যাঠা, কাকা, দাদা বলে যে যেমন খুশি ডাকে। নিষ্পাপ সহজ সরল ছেলেগুলো কোন্ ফাঁকে হৃদয়ের দুয়ার খুলে ঢুকে পড়ে। আমি একাত্ম হয়ে যাই। ফেরার পথে মাঝে মাঝে ওদের জন্য লজেন্স,বিস্কুট ইত্যাদি নিয়ে আসতাম,এর ফলে ওদের মধ্যেও ধারণা জন্ম নেয়,আমি কিছু নিয়ে আসব। অনেক সময় আমাকে জিজ্ঞাসা করত আজ কী এনেছ। সম্পর্ক হয় নিবিড় নিখাদ ভালোবাসার।পূজার সময় ওদের মুখে হাসি ফোটাতে নতুন জামা প্যান্ট কিনে দিতাম। পূজা এলেই ওরা নিঃসঙ্কোচে বলত কাকা এবার জামা কাপড় দেবে না ? কত সরলতা! পড়ন্ত বেলায় বসে বসে ভাবি সে সরলতা আজ সমাজ হতে কোথায় হারিয়ে গেল। তাই আজ দিনের শেষে একান্তে নিজেকে জিজ্ঞাসা করি এত ভালোবাসা জীবনে আর কি কোথাও পেয়েছি?
শীতের ফিরে যাওয়ার বার্তা শোনা যায়,ভোরে কোকিলের ডাক,বসন্ত আসছে,আসছে রঙের উৎসব দোল। দোলে স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে মেয়েরা রঙ খেলে,ওদের রঙ কেনার পয়সা নাই,রঙ পাবে কোথায়, ওরা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। বড়জোর মা মাসিদের পায়ে দেওয়ার আলতা বা হলুদ বাটা, জলে গুলে দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা । সে বছর দোলের আগের দিন ওদের বলে এসেছিলাম,কাল দোল, রঙ খেলা,আমি আসব তোদের সাথে রঙ খেলতে। আমার কথা শুনে তমাল,ভোলা,মহাদেব,রবি,জয়দেব, হারাধন, গোপাল সকলে এক সাথে বলে ওঠে,কাকা সত্যিই তুমি আমাদের সাথে রঙ খেলবে,আমার সম্মতিতে ওদের মুখের যে অনাবিল উজ্জ্বল হাসি দেখেছিলাম,তা তুলে রেখেছি মনের ক্যামেরায়। আমি রঙ খেলি না,ভালোও লাগে না,ওদের এই আনন্দটুকু উপভোগ করার জন্যই উদ্যোগ। ওদের বলি কাল একটু বেলা হলে আমি রঙ আর পিচকারি নিয়ে আসব। বালতির জলে রঙ গুলে সকলে এক সাথে রঙ খেলব,আমি রঙ খেলব বলাতে সকলে আনন্দে হৈ হৈ করে ওঠে, কী মজা কী মজা কাকা আমাদের সাথে রঙ খেলবে,সে কি আনন্দ উপভোগ করেছিলাম,কলমে প্রকাশ করা যাবে না।
পরের দিন একটু বেলা হলে আমি লাল,সবুজ,হলুদ রঙ আর কয়েকটা পিচকারি নিয়ে উপস্থিত হলাম বাগদি বাউড়ি পাড়াতে,আমাকে দেখে ছুটে এল একে একে তমাল,ভোলা,মহাদেব,রবি,জয়দেব,হারাধন, গোপাল। ওদের হাতে সব রঙ পিচকারি দিয়ে বালতিতে গুলতে বলি,রঙ গোলার পর শুরু হয় রঙ খেলা।পাঞ্জাবি পায়জামা পরে তৈরি হয়েই এসেছিলাম। সকলে মিলে রঙে রঙে রাঙিয়ে দেয় আমাকে। সে রঙ আজও আমার মনে লেগে রয়েছে,মুছে যায়নি, যাবেও না কোনোদিন।
ওরা বড় হয়,আমিও জড়িয়ে যাই সংসারে । সূর্য আস্তে আস্তে নেমে আসে দিগন্তের কাছে। পড়ন্ত বেলায় যখন সময় কাটে একান্তে,ক্যানভাসের ছবিগুলো উল্টে উল্টে যায়,এক এক করে ভেসে আসে তমাল,ভোলা,জয়দেব মহাদেব,গোপাল, রবি,হারাধন সকলেই, আজও সে কথা ভুলতে পারি নাই।দোল আসলেই ওরা আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights