—- রতন চক্রবর্তী
মঞ্চশিল্পী থেকে গণশিল্পী রূপশ্রী।২৪ ফেব্রুয়ারী সকালে জীবনাবসান হল এমন এক বাচিক শিল্পীর যাঁর সম্পর্কে প্রয়াত কবি তরুণ সান্যাল এক যুগ আগে বলেছিলেন,মঞ্চের প্রভূত সম্ভাবনাময় শিল্পীর গণশিল্পী হয়ে ওঠার বিবর্তনের কথা।আর শিল্পীর আত্ম-জিজ্ঞাসা মূল্যায়ন ছিল “—- মঞ্চের শিল্পীকে মিছিলের বন্যায় ভাসিয়ে আনল মানুষ!” আবৃত্তি শেখা,মনোরম মঞ্চে দাঁড়িয়ে দু-চারশো লোক থেকে ঘেরাও-অবস্থান, জন জোয়ারের চলমান মঞ্চ,জনসভায় হাজারো মানুষের সমনে আবৃতি বা শ্রুতি নাটক করা,শিশু,কিশোর, তরুণদের আবৃত্তি শেখানো এ সবই রূপশ্রীর কাছে ছিল সংগ্রামের শিক্ষানবিশী থেকে সংগ্রামী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার প্রথমে হয়তো বা অবচেতন ও পরে সচেতন প্রয়াস।তিনি প্রায় আড়াই মাস রোগশয্যায় থেকে চলমান জগতে পুনর্বাসিত হওয়ার যে অপরিসীম সংগ্রাম চালিয়েছেন তা কলকাত হার্ট ক্লিনিকের ডাক্তারবাবুদের বিশেষ টিম থেকে শুরু করে দেশের কয়েকজন সেরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিভূত করেছে।রূপশ্রীও নিশ্চিত ভাবেই যাওয়ার আগে অনুভুব করতে পেরেছেন, বিশেষ করে হার্ট ক্লিনিকের চিকিৎসকরা কীভাবে প্রবল সংকটে জীবনের প্রহরী হিসেবে মৃত্যুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর রূপশ্রীর আত্মজন,সুহৃদজন,শ্রদ্ধাস্পদ,অনুরাগীজন ও স্নেহাস্পদরা বিষন্ন বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে রোগী ও চিকিৎসক এই দু’পক্ষের যৌথ সংগ্রাম।এ যেন জীবন ও গণ-সংস্কৃতির প্রতি রক্তিম শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন! সংগ্রাম ছিল রূপশ্রীর রক্তধারায়।জন্ম স্বদেশী আন্দোলনের এক বিশিষ্ট পরিবারে(২.৬.১৯৬২—২৪.২.২০২৪)।নিকট সম্পর্কের ঠাকুর্দা অনুশীলন দলের অন্যতম স্থপতি আশুতোষ কাহালী ছিলেন সম্মননীয় কংগ্রেস নেতা।বাবা সন্তোষ কাহালীও পিতৃপুরুষের উত্তারাধিকার বহন করে কংগ্রেসের নেতৃত্বস্থনীয় ব্যক্তিত্ব হয়েছিলেন।রূপশ্রী একাধারে গান্ধিজির ভক্ত এবং মননে মার্ক্স-লেনিনে অনুরক্ত। উইমেন্স কলেজে পড়ার সময় ছাত্রপরিষদ ইউনিয়ন পরিচালিত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা ছিলেন।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর বিভাগে ভাষাতত্ত্ব পড়ার সময় ছাত্র পরিষদের সমর্থক থাকলেও কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী ছাত্রদের সংগে সহজেই মিলেমিশে থাকতেন।মাত্র এগারো বছর বয়সে বিধান নগরে এ আই সি সি অধিবেশনে আবৃত্তি শুনিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধীকে। ইন্দিরা শীতগ্রস্ত সেই কন্যার গায়ে জড়িয়ে দেন নিজের চাদর।প্রিয় দাসমুন্সিকে বলেন একটি শাল কিনে দিতে। সুচিত্রা মিত্র পরিচালনায় রেকর্ডিং হয়েছিল ররবীন্দ্রনাথের শিশু ভোলানাথ অবলম্বনে একটি অনুষ্ঠান। আংশ নিয়েছিলেন রাধারমণ,দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো প্রথিতযশাগণও।বাচিক শিল্পী জীবনে শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ ঘোষ-গৌরী ঘোষ জুটি,জগন্নাথ-ঊর্মিমালা জুটি, পঙ্কজ সাহা,বিজয়লক্ষ্মী বর্মণ,ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়দের স্নেহ-ভালবাসাপূর্ণ সান্নিধ্য পেয়েছেন।ভিতটি গড়ে উঠেছিল বালিকা বেলায় ইন্দিরাদেবীর পরিচালনায় আকাশবাণীর আসরে।পরবর্তী সময়ে আকাশবাণী ও দূরদর্শনের কিছু অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। একসময় মহাবোধি স্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলেন।অল্প কিছু সময় পরে তাঁর মনে হয়েছিল,বাচিক শিল্প চর্চাই তাঁর আনন্দের নন্দনকানন। তাঁর আবৃত্তির সিডি “হে মোর দুর্ভাগা দেশ” প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মহাশ্বেতাদেবী,কবি তরুণ সন্যাল,শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, প্রতুল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সজ্জন-সুজন।শিল্পী সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক কর্মী বুদ্ধিজীবী মঞ্চ প্রযোজিত “যাক ছিঁড়ে যাক মিথ্যার জাল” শ্রুতি নাটকের ক্যাসেট রূপশ্রীর অভিনয়ের প্রসাদগুণে বিপুল সাড়া ফেলেছিল নন্দিগ্রাম- সিঙ্গুর আন্দোলনে।এই সিডিটি প্রকাশ করেছিলেন মহাশ্বতাদেবী ও বিভাস চক্রবর্তী। রীপশ্রী ছিলেন বুদ্ধিজীবী মঞ্চের অত্যন্ত আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ও নেতৃত্ব মন্ডলীর একজন শীর্ষ ব্যক্তিত্ব।এছাড়া ভাষা শহিদ স্মারক সমিতি,বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব প্রভৃতি গণসংঠনের সংগে যুক্ত ছিলেন।সপ্তাহ পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য ছিলেন তিনি।সুভাষ মুখোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে তাঁর আবৃত্তির অনুষ্ঠান ছিল নিয়মিত।দুই বাংলা জুড়েই তিনি তাঁর অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন।তাঁর সর্বশেষ মঞ্চানুষ্ঠান ছিল গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে বুদ্ধিজীবী মঞ্চের উদ্যোগে মধুসূদন মঞ্চে কবি শ্রীমধুসূদন,শরৎচন্দ্র, নজরুল স্মরণ।পরের মাসেই তিনি বাংলাদেশ গিয়েছিলেন নানা অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করতে। একদা আবৃত্তিশ্রী অভিদায় ভূষিত রূপশ্রী কাহালী বিভিন্ন সময়ে আবৃত্তি শেখাতেন নেহরু চিলড্রেন মিউজিয়াম, কাব্যায়ন,মজারু,কবিতার পাঠশালা এবং কলকাতা হার্ট ক্লিনিকের বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের সন্তানদের জন্য সংগঠিত নিয়মিত ওয়ার্কশপে। তিনি রেখে গিয়েছেন তাঁর দুই কন্যা সন্তানকে, তাঁর সমস্ত প্রিয় জনদের কাছে।তাঁর প্রয়ানে পরিচিত সবাই,গুণাগ্রহীবৃন্দ,তাঁর সংগে যুক্ত সমস্ত সংগঠন, বহু বিশিষ্টজন এবং নানা শাখার সহ শিল্পীজন শোকস্তব্ধ।