আজ থেকে প্রায় আড়াই তিনশো বছর আগের কথা।আজকের কলকাতার সবচেয়ে সুন্দর রাস্তাটি ছিল লালবাজারে, পুরোপুরি ছবির মতো সুন্দর। আজ কলকাতায় যেখানে বিবাদী বাগ, তার ঠিক উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে বৌবাজার পর্যন্ত ছিল এই রাস্তা। তখন ‘ক্যালকাটা’র এই রাস্তাটি ছিল ইংরেজদের মতে ‘বেস্ট স্ট্রিট অফ ক্যালকাটা’ । লন্ডনের রাস্তাগুলির আদলে বানানো এই সড়কটি। এই পথের নাম ‘অ্যাভিনিউ টু দ্য ইস্টওয়ার্ড’ দিয়েছিলেন ব্রিটিশরা । যদিও স্থানীয়রা এটিকে ‘গ্রেট বাংলো রোড’ বলতেন। কারণ, একটি প্রাসাদোপম বাড়ি এই রাস্তাতেই অবস্থিত ছিল ।এই বাড়ির মালিক ছিলেন জন পামার তৎকালীন কলকাতার অন্যতম ধনকুবের ব্যবসায়ী । এই বাড়িটিতে
তেরোটি আর্চ এবং ‘পোরবন্দর থাম’ (Porebunder Columns) আছে।আজ সেই দক্ষিণমুখী চারতলা বাড়িতেই কলকাতা পুলিশের প্রধান কার্যালয়ের অবস্থিত। যার আজ নাম লালবাজার।
তবে নানা মুনির নানা মত থাকলেও বলা ভালো, বর্তমান যেখানে লালবাজার। সেখানে এলাকায় একসময় সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের একটি কাছারিবাড়ি ছিল। আর দোলের সময়, লালদীঘি ও তার সংলগ্ন এলাকা আবির ও কুমকুমের রঙে লালবর্ণ ধারণ করত। তাই থেকে এই দিঘির নাম লাল দিঘী। আর থেকেই লালবাজার’ নামকরণ।
তবে বাংলার তথা ভারতীয় সংস্কৃতিকে নিচু দেখাতে এই ধারণা অনেকেই মানতে চায় না।
বলা হয় লাল রঙের প্রাচীন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গটির ছায়াও নাকি পড়ত এই লালদীঘিতে। সেই থেকেই এলাকাটির নাম লালবাজার হয়েছে। আবার এই মুক্তি বাজারে প্রচলিত আছে ‘লাল’ শব্দটির উৎস আসলে পুলিশের পাগড়ী।কেউ কেউ বলেন তৎকালীন পুলিশ কনস্টেবলদের লাল পাগড়ির পড়তেন তাই থেকে এসেছে লালবাজার শব্দটি। যদিও, মতটির মানা সম্ভব নয়। কারণ বাড়িটির নাম ‘লালবাজার’ হওয়ার অনেক পরে লাল পাগড়ি পরতে শুরু করেন কনস্টেবলরা।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে গবেষক ভোলানাথ চন্দ্র লালবাজার-কে একটি বাজার হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন লালমোহন বসাক এই বাজারটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ।সেই থেকেই নাকি ’ লালবাজার’।’
রেভারেন্ড জেমস্ লঙ লালবাজারের নামকরণের কারণ হিসেবে, লাল ইটে তৈরি মিশন চার্চ বা লাল গির্জাটিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। এই লাল গির্জাটি জন জাকারিয়া কারন্যান্ডার ১৭৬৮ সালে নির্মাণ করেছিলেন । বাংলার প্রথম প্রোটেস্টান্ট পাদ্রী ছিলেন তিনি । কিন্তু গির্জাটির প্রতিষ্ঠার বহু আগেই ১৭৪৫ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির নথিপত্রে লালবাজারের উল্লেখ পাওয়া যায়। জন হলওয়েল, ১৭৫১-৫৬ সালে কলকাতার কালেক্টর ছিলেন। তিনি এই এলাকার সম্পর্কে বলেছেন – এটি বাজার নয়, জনবসতি হিসেবেই পরিচিত ছিল। দশ বিঘা নয় কাঠা জমি।এখান প্রায় ৮১টি বাড়ি ছিল এই এলাকায়।
অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে লালবাজার এলাকায় ব্রিটিশরা অনেকটা সময় কাটাতেন।সেই সময় বিখ্যাত রিসর্ট ‘হারমোনিক ট্যাভার্ন’ অবস্থিত ছিল লালবাজারে গা ঘেঁষে। তখন এই ট্যাভার্ন, উচ্চবিত্ত ইংরেজ নারী-পুরুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয় ছিল। প্রতি সন্ধ্যায় এই জায়গাটা সুর এবং সুরায় জমজমাট হয়ে উঠত ।এমনকি এখানেই ওয়ারেন হেস্টিংস-এর ফেয়ারওয়েল পার্টি আয়োজিত হয়েছিল । ‘লাল’-এর উৎস হিসেবে তাই ‘loll’ শব্দটিও গুরুত্ব দেয় অনেকে।এটি ‘loll shrub’-এর অপভ্রংশ। ‘লল শ্রব’ মানে লাল সুরা। loll shrub পাওয়া যেতো বলেই ’ loll bazar’ এবং তা থেকে লালবাজারে নামকরন।
অতো বিতর্ক মাঝে একটাই কথা মনে হয় বার বার। বাঙালি তার ইতিহাস নিয়ে উদাসীন। তার তাই তার ঐতিহ্য ময় ইতিহাস চাপা পরে যায় নানা গালগল্পে।