লেখক – সায়ন রায়
প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও অশোকনগরের বানীপুরে মহাসমারোহে বসেছিল লোকশিল্প মেলা৷ কি নেই সেখানে! রঙ-বেরঙের কাঁচের চুড়ি,হাজার আলোর রোশনাই মোড়া নাগরদোলা,শতসহস্র ঝাঁচকচকে দোকানপাট৷ তারই মাঝে চাপা পড়ে থাকা দু-চারটি হাতে গোনা লোকশিল্পের দোকান৷ কাঠের খেলনা গাড়ি, মাটির কলসি,হাড়ি-পাঁতিল,ভান্ডার, ফলপাকুড় ও বিশেষ আকর্ষণ ঘাড়নাড়া বুড়ো পুতুল৷ বানীপুর লোকশিল্প মেলায় আগে ঘাড়নাড়া বুড়ো পুতুল নিয়ে আসতেন শ্রীমতি বুলুরানী পাল৷ বয়স তাঁর জানা নেই৷ আমি গত দুবছর যাবত গিয়েও তাকে এই মেলায় বসতে দেখিনি! স্থানীয়দের কাছে খোঁজ নিয়ে জানলাম তিনি এখন আর বসেন না। বুলুরানী পালের বাড়ি ওই অশোকনগেরই৷ সেই অশোকনগর বানীপুরেরই আরেক শিল্পী হলেন গোপাল পাল৷ তিনি কয়েক দশক যাবত লোকশিল্পের ক্ষুদ্র পরিসর নিয়ে বিভিন্ন মেলায় বসেন৷ মধ্যমগ্রামের রাসের মেলা, বানীপুরের লোকশিল্প মেলা, ঠাকুরনগরের পি.এন ঠাকুরের মেলা ও গোবরডাঙ্গার বৈশাখী মেলায় তিনি বসেন৷
কত বছর আর তিনি এই লোকশিল্পের ক্ষুদ্র পরিসর নিয়ে মেলায় মেলায় বসবেন তা আমি জানি না! বংশ পরম্পরা নয়! বাবা প্রতিমা গড়তেন,পুতুল নয়! গোপাল বাবুর হাত ধরেই পুতুল এসেছে এই সকল মেলায়৷ গোপাল বাবুর ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার৷ খুব কষ্ট করেই ছেলেকে পড়ালেখা শিখিয়েছেন গোপাল বাবু৷তিনি আক্ষেপের সুরে বললেন, মাটির কাজে ক-টাকাই বা আসে! ছেলেকে এপথে আনেননি তিনি৷ লোকশিল্প কি তাহলে তাঁর চলার পথেই বন্ধ হয়ে যাবে? কৌতূহলী প্রশ্ন আমার — শুধু মুখের দিকে চেয়ে রইলেন৷ প্রথমে উত্তর দিতে পারলেন না! শুধু একটা কথাই বললেন একাজে টাকা নেই! তার বক্তব্য আগামী প্রজন্ম শিখবে না মাটির কাজ,পুতুল গড়ার কাজ৷ তোমরা যা পারো এখনই সংগ্রহ করো৷
এযাবতকাল গোপালবাবু সিগারেট খাওয়া সাহেব বুড়ো পুতুল বানান৷ এগুলি কাঁচামাটির রঙিন পুতুল।পুতুলগুলির উচ্চতা প্রায় ছয় ইঞ্চি৷
আমি একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি বাংলার চিরাচরিত হুঁকোটানা গ্রাম্য বুড়ো পুতুলটি বানান না? উত্তরে উনি বললেন — ‘বাবা একসময় বানাতাম, তখন চাহিদা ছিল। এখন একদমই চাহিদা নেই! কয়েকবছর আগে ঠাকুরনগরের মেলায় কুড়িটা মতো হুঁকো খাওয়া বুড়ো পুতুল বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম৷ বিশ্বাস করবে না! একটাও পুতুলও বিক্রি হয়নি! খুব খারাপ লেগেছিল। তারপর থেকে আর বানাই না’!
আমি আশ্বাস দিয়ে বললাম যে- আপনি এবছর আবার তৈরি করুন। কমপক্ষে দশটা বানান৷ যদি বিক্রি না হয় তাহলে আমি সবকটি কিনে নেবো৷ উনি আমায় সেদিন ভরসা করেছিলেন৷ এবছর প্রত্যেকটি পুতুল বিক্রি হয়েছে৷ আজ লিখতে বসে,এই লেখার মধ্যে দিয়েই জানাচ্ছি সেই দিনটিই ছিল আমার কাছে পরম পাওয়া একটি বিশেষ দিন৷ আমরা যারা অল্পসল্প লেখালেখি করি ও সামান্য কিছু লোকশিল্পের ছিটেফোঁটা জিনিস সংগ্রহ করেছি, তারা লোকশিল্পী ও লোকশিল্পের এই বিরাট ব্যাপ্তিকে জন্ম দিতে পারি না বা পারিনি! তাদেরকে শুধু উৎসাহিত করতে পারি৷ তাদের হাতটা ধরতে পারি৷ তাদের পা টা ছুঁতে পারি৷ এখানেই আমাদের সার্থকতা।এটাই আমাদের স্বপ্ন৷
সহযোগিতায় – গোপাল বাবুর স্ত্রী, শুভঙ্কর দাস, আকাশ বিশ্বাস, বাপন সরেন, দেবায়ন গোস্বামী, মানব মন্ডল প্রমুখরা৷
পুতুল শিল্পীর যোগাযোগ নম্বর – ৯৮৩২৮৩৬৬৭৯
লেখকের যোগাযোগ নম্বর – ৬২৯০৫১৭৪৬৭