অনুপম মাইতি
লেখক গবেষক শ্রী সঞ্জয় ঘোষ সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব কালচারাল এনথোপলজিস্ট এর এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ।প্রথাগত ধারণা গদ বাঁধা রীতিকে এড়িয়ে বাস্তবমুখী অন্তমুখী অন্তর চেতনা সন্ধানে আমাদের গোচরে অগোচরে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্য লোকসংস্কৃতি যে ধারা বয়ে চলেছে তার অতীতের বই আনা সংস্কৃতি আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি লেখক সঞ্জয় ঘোষ তার আত্ম অনুসন্ধিৎস্য মন নিয়ে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
আলোচ্য সুন্দরবনের পূর্বপুরুষ তার গবেষণার ফসল আমাদের জানা-অজানা অনেক জিনিসকে তার অপারেশন টেবিলে ডিসেকশন করেছেন, যুক্তির অন্তর্জালে বিশ্লেষণ করেছেন।
লেখকের এই বই তার পরিমার্জনের দ্বিতীয় প্রকাশ। এই বই আলোচনার শুরুতে, লেখকেরএই বই লেখার যে তাগিদ বা অনুপ্রেরণা কথা না বললে নির্মাণ গড়ে তোলার অনেক কথাই বাদ চলে যায়।
শহরতলীর যাদবপুরের আবাস ছেড়ে পৈত্রিক বসতি মজিলপুরে বসবাস স্থানীয় মানুষের আচার বিচার সংস্কৃতি তাকে এক নতুন ভাবে নতুন জগতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করায়। পারিবারিক লেখাপড়ার এক সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা বাবা বিশেষ বাবা বিশেষত মায়ের পড়াশোনা অভ্যাস তার অনুপ্রেরণা বা মন্ত্র লেখাপড়া ডিগ্রি থেকে কিছু পাবার প্রত্যাশা নয় বরং জানার ইচ্ছায় জীবন ভোর চালিত করেছে। শহুরে রাজনৈতিক জীবন বনাম গ্রামীন বিশেষত সুন্দরবনের অবহেলিত অশিক্ষিত আদিবাসী নিচু জাতি ও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের থেকে কিছু শেখার আছে এই মনোভাব তাকে ক্ষেত্র সমীক্ষা ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে। ক্ষেত্র সমীক্ষায় মায়ের স্নেহ মাখা ঘটনাগুলো লেখকের ক্ষেত্র সমীক্ষা যাওয়ার আগে টাকা পয়সা গুছিয়ে ব্যাগ গোছানো পানীয় জল রুমাল গুছিয়ে রাখা ব্যাটারি চালিত ঘড়ি কিনে রাখা জীবনে বিশাল দাগ কেটে দেয়। লেখকের মামা মাইমা দাদু দিদা সবার ভালোবাসা অনুপ্রেরণা এই লেখার মধ্যে অনুপ্রাণিত করেছে।
লেখকের শেষ জীবনে বারবার সাধনা বিঘ্ন করেছে শরীকী দের কুটিল হিংসায় জর্জরিত তাকে বেঘর করার চক্রান্ত, শারীরিক মানসিক নির্যাতন। তিনি তার স্বপ্ন মায়ের স্মৃতিতে গড়ে ওঠা ছোট সংগ্রহশালা ঠিকমত প্রদর্শন না করার আক্ষেপ তুলে ধরেছেন। লেখক জানিয়েছেন তার বাসস্থানের কাছে লৌকিক দেবদেবীর মূর্তি , বারা মূর্তি, প্রত্নতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব সম্বলিত বস্তু গুলি মনকে গভীরভাবে আলোকিত করেছে। তাই তিনি বলেন “মূলত মায়ের কাছ থেকে পাওয়া প্রথা বহির্ভূত পড়াশোনার বাল্যকৈশোরের অভ্যাস যৌবন উত্তীর্ণ মধ্যান্যে গভীর অনুশীলনের রূপ নিল, বিনয় ঘোষ এর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ দারুন ভাবে প্রভাবিত করল মনকে। নিজস্ব পথ অনুশীলনের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে থাকল সাংস্কৃতিক ও তথ্য যে বিরাট সম্ভাবনার জগতের দ্বার খুলে দিল আমার সামনে সে জগতে প্রবেশ করে আদিবাসী সংস্কৃতির লোকসংস্কৃতির নৃতত্ত্ব ও প্রতিরোধের সম্মিলিত অনুশীলনে আঞ্চলিক সংস্কৃতি উত্থান ও আঞ্চলিক ইতিহাস উদ্ধার সম্ভাব হবে বলে ধারণা সৃষ্টিতে থাকল বর্তমানে ক্ষেত্র গবেষণামূলক গ্রন্থটি সেই চিন্তারই ফসল”।
লেখক তার বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার আগে আদিম সমাজের পূর্ব পুরুষ পূজা , সুন্দরবন সংস্কৃতির অংশ ও বাহক সম্পর্কে সংক্ষেপে বলেছেন।
আদিম সমাজের পুরোপুরুষ পূজা বলতে তাদের ধারণায় প্রবীণ ,প্রবীনাদের মৃত্যুকে সহজ মেনে না নেওয়ায় পুরুষের আত্মাকে তারা বনজ প্রাণীর প্রাণী যেমন বাঘ হাতি ভালুক প্রভৃতির দেহের স্থানান্তরিত করে যাকে টোটেম রূপে পরিগ্রহণ করে।
সুন্দরবন সংস্কৃতির অঞ্চল বাহক নিবন্ধে গবেষক সুন্দরবন অঞ্চলের বিস্তৃতি জনসংখ্যা ভৌগোলিক গুরুত্বের কথা তুলে ধরেছেন যেটা ভারত বাংলাদেশ জুড়ে রয়েছে। আলোচিত বিভিন্ন জনজাতির কথা তাদের সমাগমের ফলে লোকসংস্কৃতি বনাম নৃতাত্ত্বিক সংস্কৃতি ফুটে উঠেছে।
লেখক তার প্রথম অধ্যায়ে সুন্দরবনের পূর্ব পুরুষ পূজা নিবন্ধে বিভিন্ন ক্ষেত্র সমীক্ষার মাধ্যমে যেমন জয়নগরের কুলতলী, কঙ্কন, রায়দিঘির আদিবাসী পাড়ায় মুন্ডা, কোরা ও বিভিন্ন বসবাসকারী আদিবাসী যাদের পূর্বপুরুষ পুরুলিয়া থেকে এসেছে তাদের তাদের রিচুয়াল এর নানা প্রকার প্রথা যেমন ‘ ভিতর বুড়ি’ ‘ভিতর বুড়ি’ ইত্যাদি পূজায় বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ,ভেরিয়েশন কোথায় কি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে, সোদর ব্রত যাহা আদিবাসীদের বুড়োবুড়ি তথা পূর্বপুরুষের পূজা যা নিম্ন বর্গের হিন্দুদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে তার সচল চিত্র তুলে ধরেছেন। এই পড়বে তিনি নিম্নবর্গীয় সম্প্রদায় যেমন বাগদি থেকে কুলীন কায়স্থ জাতির মধ্যে জয়নগরের বিষ্ণুপুর, মণিরতটে যে গভীর ক্ষেত্র সমীক্ষা করেছেন তাতে যে চিত্র ফুটে উঠেছে সুদোর ব্রত ও বুড়োবুড়ি পূজোর কম্পারেটিভ চিত্র প্রকাশ করেছেন এবং আদিম মানুষের বন্য বাসস্থান থেকে কৃষি যুগের এভুলেশন তা রিচুয়ালে ছাপ পড়েছে। বুড়োবুড়ি থেকে সোদোর ব্রত,
অখন্ড পাথর মাটি, গাছ থেকে সিঁদুর তীর ধনুক মাটির পুতুল পাশাপাশি ধানের শীষ বাড়ি ভর্তি ধান পিঠে পড়ো পূজা নির্মিত মুড়ি, মুড়কি, চালের গুঁড়ো যার মধ্যে দিয়ে পুরা প্রস্তর ও মধ্যপ্রস্তর যুগ থেকে মানব সমাজে উত্তরণ বয়ে আনা সংস্কৃতি যা এখনও প্রবহমান তা নিম্নজ বর্গের মধ্যে দিয়ে হিন্দু সমাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। লেখক বলেছেন নব্য প্রস্তর যুগের সৃষ্টি কৃষি ও বিশেষত পশু পালন শুরু হয় জন্ম রহস্য পুরুষ ও নারীর যুগ ভূমিকা মানুষের ধারণা জন্মায় সেই সময় থেকে পুত্র বা পতি হিসাবে পুরুষ দের আবির্ভাব হয় এই মতামত ব্যক্ত করেছেন। বাগদিদের মধ্যে সোদর ব্রত আদিবাসী বুড়োবুড়ির পূর্বপুরুষ পূজাকেই স্মরণ করায়। আবার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে সোদর মা সোদর বুড়ি পূজা পুণ্ড্রক্ষত্রিয়দের লক্ষ্মীনারায়ণ রূপে পূজা হচ্ছে। লেখক জনসংখ্যা সংক্রান্ত স্ট্যাটিস্টিকাল ডেটার মধ্যে দিয়ে বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর, হাওড়া, বীরভূম, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণারর ৮৫% বাগদি জন সংখ্যা যাদের শারীরিক মিল দিয়ে সাঁওতাল উপজাতি ও বাগদি জাতির নিকট সম্পর্কের ইঙ্গিত করেছেন।
তৃতীয় অধ্যায় লক্ষ্মী গণেশ অনু আদিবাসী পূর্বপুরুষ পূজার অপর দ্বারা নিবন্ধে ক্ষেত্র সমীক্ষার মাধ্যমে লক্ষ্মী গণেশের ঘট ফর্মের উৎস অনুসন্ধান করে দেখিয়েছেন। লক্ষ্মী আদি মাতা ও পৃথিবীর মাতা এই দুয়ের রূপ, হাতি রূপ সম্বন্ধে আলোচনায় তিনি ১) জুমর্ফিক/ পশু রূপধারী, ২) থেরিওমর্ফিক/ মিশ্র রূপধারী অর্ধ পশু মানব ৩) আন্থ্রো মর্ফিক/ মানব রূপধারী এই রকম ক্রম অনুসৃত হয়েছিল। গণেশ পূজার উৎসে যে হাতি পূজো যা এখনও ঝাড়খন্ড জেলায় ও ঝাড়খন্ড সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলিতে হয়ে থাকে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার প্রাপ্ত প্রত্ন হাতিগুলি ধ্রুপদী এখানে আগত পূর্ব মেদিনীপুরে আগত মানুষের উচ্চভূমিতে কিন্তু হাতি পাওয়া যায় না। যদিও টলেমি বর্ণিত গঙ্গারিডি সভ্যতার বিরাট হস্তী বাহিনীর কথা আছে। তা সবটাই চালান হাতি। অথচ গবেষক দেবিশংকর মিদ্দার সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে হাতি ঘট যা মেদিনীপুর থেকে আগত জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ এই পূজোর ধারা। লেখক উসকে দিয়েছেন হাতি পদবী ধারী টোটেম উপগোষ্ঠির কথা, বলেছেন হাতির উপদ্রপ থেকে বাঁচাতে রঙ্কিনী দেবীর পুজোর কথা। যার বাহন হাতি যা জঙ্গল থেকে সমতলে লক্ষী গণেশের রূপান্তরের কথা। তুলে ধরেছেন বরাশির যুগী সম্প্রদায়ের কথা যাদের বর্তমান পদবী দেবনাথ। যাদের বাস একদা হাতিপাড়া বলে খ্যাত। যাদের উৎভব যুগি সোরেন সম্প্রদায় থেকে। উল্লেখ করেছেন বরাশী ও জয়নগরে প্রাপ্ত রঙ্কিনি দেবীর কথা ও তার বৈশিষ্ট্য।
চতুর্থ অধ্যায় লেখক সুন্দরবনের অন -আদিবাসী পূর্বপুরুষ পূজার জনপ্রিয় ধারা বারামূর্তি, দক্ষিণ রায় পূজা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। বারা মূর্তির উৎস সম্পর্কে ঘটকে বোঝানো হয়। শীতলা চণ্ডীর ঘটকে বারা বলা হলেও দক্ষিণ রায়ের পূজোর সময় থেকে বারা মূর্তি প্রসারতা লাভ করে। এই বারা মূর্তি পূজার উদ্ভব হয়েছে আদিম মানুষের খুলি পুজো থেকে। এই সম্পর্কে লেখক বহু উদাহরন তুলে ধরেছেন। তিনি বিস্তারিত আলাপ আলোচনার মাধ্যমে দেখিয়েছেন দক্ষিণ রায় কিভাবে আদিবাসী , নিম্নবর্গদের পূজা থেকে কিভাবে ব্রাহ্মণ ধারায় অভিষিক্ত হয়েছে। তিনি আরো দেখিয়েছেন আদিবাসীদের বাঘুৎ মূর্তি পূজা ধর্ম পুজোর ধারায় সংমিশ্রিত হয়ে পূজার উদ্ভব তিনি এই প্রসঙ্গে চমকপ্রদ উদাহরণ দেখিয়েছেন রায়দিঘি থানার পশ্চিম জটা গ্রামে মুদিপাড়ায় এগারোটা ঘট প্রতীকে গাজিবাবা, নয় বিবি ,ভান সিং, বাঘুৎ এর এক সঙ্গে পুজো হচ্ছে। তিনি আরো উদাহরণ দেখিয়েছেন জয়নগরে ধন্বন্তরী মন্দিরে দেবীর ডান দিকে একটি কাঠের বারা মূর্তি আছে। যার সাজস্জায়আদিবাসীদের মনে করায়। লেখকের মতে , আদিবাসীদের কাছে যা বাঘুৎ ,+ ধর্ম+ভান সিং, হিন্দুদের কাছে তা বারা মূর্তি দক্ষিণ রায়, মুসলিমদের কাছে পীর। লোকদেবতা ধর্ম ঠাকুর ক্রমে ক্রমে পঞ্চানন্দের মধ্যে দিয়ে পরিপূর্ণভাবে শিবের রূপান্তরিত হয়েছে তার বহু উদাহরণ তিনি দেখিয়েছেন।
লেখক তার অন্তিম অধ্যায় পঞ্চম অধ্যায় পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে অন -আদিবাসী পূর্ব পুরুষ পূজার অন্যতম জনপ্রিয় ধারার অনেক সাদাকালো ছবি দিয়ে বইকে সমৃদ্ধ করেছেন।
লেখক সঞ্জয় ঘোষ এই বইয়ের মাধ্যমে তিনি লোককৃষ্টি বনাম নৃতাত্ত্বিক সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধশালি ধারাকে যেমন প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি অনেকগুলো প্রশ্ন কিন্তু অমীমাংসিত থেকে গেছে আমার কাছে ১) কৃষি কার্য ও পশুপালন পর্বেই পিতার ভুমিকা স্পষ্ট হওয়ার কথা বলেছেন তার আগেই কেন স্পষ্ট হলো না,২) খুলি পূজোর বর্তমান ও অতীত রূপের প্রান্তীয় বাংলা ও ঝাড়খন্ড অঞ্চলের উদাহরণ তুলে ধরলে ভালো হতো। ৩) আরেকটি ব্যাপারে লেখক নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে হাতি পূজোর গণেশ মূর্তির রূপান্তর ঘটে মানবরূপী গণেশ ও তার হাতি বাহন হওয়া উচিত ছিল কিন্তু তা হল না কেন এর উত্তর লেখকের কাছে নেই। সর্বশেষে প্যারালাল প্রকাশক কে ধন্যবাদ যাদের উদ্যোগে এই অমূল্য বই প্রকাশিত হতে পেরেছে।