ইতু কথা : উৎস ও স্বরূপ সন্ধানে #

schedule
2024-12-17 | 12:01h
update
2024-12-17 | 12:01h
person
kolkatarsomoy.com
domain
kolkatarsomoy.com

দেবী শংকর মিদ্দ্যা

আজ অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি । ইতু ব্রতের সমাপ্তি । সকাল থেকে ফেস বুকে এই ব্রত বা পুজো সংক্রান্ত অনেকগুলি পোস্ট দেখলাম । প্রতিটি লেখা বহু চর্চিত । পণ্ডিত বর্গের অভিমত: ইতু একটি সূর্য পুজো । লোক-সংস্কৃতিবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, “ইতু শব্দটি সংস্কৃত ‘আদিত্য’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে , আদিত্য অর্থ সূর্য ।” অন্যেরা বলেছেন, ‘ মিত্র ‘ থেকে ইতু ব্যুৎপত্তি লাভ করেছে । অগ্রহায়ণ মাসে সূর্যের নাম মিত্র । মিত্র থেকে ইতু । কিন্তু ভাষাচার্য সুকুমার সেন মনে করেন, ইন্দ্র থেকে ইতু । মেয়েরা ইন্দ্রের ব্রত রেখে তাঁর কাছ থেকে সন্তান , সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি লাভ করে । সুতরাং ব্যাখ্যাগুলি সবই বৈদিক আর্য কেন্দ্রিক । আর গবেষক হিসাবে সবথেকে নিরাপদ থাকা হবে , যদি সূর্য পূজা বলা যায় । গাজন , ধর্মঠাকুর থেকে আরম্ভ করে ছট, ইতু, পৌষ সংক্রান্তি সব গুলিকেই একটি বিরাট বন্ধনীর মধ্যে সূর্য পূজা দাগিয়ে দিলে গবেষক হিসাবে নিরাপদ থাকা যায় , কিন্তু মধ্যকার স্বাতন্ত্রগুলি চাপা পড়ে যায় যে ! কেবল বৈদিক ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের সংস্কৃতি শুরু হয়নি । ইতুর কৃত্য আর উপাদান কি ঋগ্বেদীয় ? আদৌ তা নয় । এ ঐতিহ্য তো সুপ্রাচীন । ইতুর কৃত্যগুলি একটু স্মরণ করা যাক :ইতু মেয়েদের ব্রত । বাংলার সিংহভাগ ব্রতই মেয়েদের । সাধারণত কার্তিক সংক্রান্তিতে একটি বড় সরার মধ্যে পরিবারে যতজন মেয়ে আছে তত সংখ্যক পোড়ামাটির ছোট ঘট ( কোনা বা কনা নামে উচ্চারিত ) বসানো হয় । বড়পাত্রের মধ্যে ধান, ওড়া, মান, কচু, হলুদ , সুষণি, কলমি , হিঞ্চে গাছ বসিয়ে মটর, সরষে , কলাই প্লভৃতি ছড়িয়ে দেওয়া হয় । ঘটের মুখে ধানের শীষ বা পরিবার ভেদে পল্লব বা অন্য কিছুও দেওয়া হতে পারে । এটি তুলসি থানে বা ঠাকুর ঘরে পেতে মেয়েরা এক মাস অবধি প্রত্যেক দিন বা নির্দিষ্ট বারে মন্ত্র বা ছড়া বলে জল দেয় ও পূজা করে । কোথাও ব্রাহ্মণও পুজো করে দেয় । অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে বিশেষ পূজা হয় । পিঠে ও পায়েস দিয়ে ইতুর পূজা দিয়ে সন্ধ্যায় শাঁখ, ঘন্টা, কাঁসর বাজিয়ে পুকুরে ইতু বিসর্জন দেওয়া হয় । ঘাটের পাশে জলে ইতুর সারা ডোবানোর থাকে । তারপরের দিন বা তিনদিন পর সেই সরা ও ঘট তুলে শিশুদের খেলার সামগ্রী হয় । কোথাও কোথাও অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির তিনদিন আগে বা সংক্রান্তির দিন সকালে এই সরা পাতা হয় এবং সংক্রান্তির সন্ধ্যেতে বিসর্জন দেওয়া হয় । এই ঘট বা সরা পাতাকে বারি পাতাও বলে । সরায় জল দিয়ে মেয়েদের ছড়া বা মন্ত্র বলা স্থান ভেদে পৃথক । কিন্তু মোটামুটি ছড়াটা এই রকম হয় – ” ইতু দেয় বর / ধনধান্যে পুত্রপৌত্রে বাড়ে যেন ঘর ।”কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে শুরু এবং অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে সমাপ্তি । সূর্যের আয়ণ সংক্রান্ত কারণে এবং রবিশস্যের অঙ্কুরোদ্গমে শীতের সূর্যের অপরিহার্যতার কারণে এই ব্রত সূর্যপুজো অভিধা প্রাপ্ত । কিন্তু এর সঙ্গে রয়েছে সন্তান কামনা । ঘটে একটু একটু জল দিয়ে ভরিয়া তোলা নারীর গর্ভবতী বা পুত্রবতী কামনাকে মনে করিয়ে দেয় । বিশেষ করে অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির বিশেষ পুজোকে অনেক অঞ্চলে ইতুর সাধ ভক্ষণ বলা হয় । পুরো কৃত্যটি উর্বরা শক্তির ব্রত । পৃথিবী ( শস্য ) ও মানব নারী উভয়ের ।মনে রাখতে হবে ভারতে ৬৫ হাজার বছর পূর্বে আদি মানবেরা ( হোমো স্যাপিয়েন্স) ভারতে প্রবেশ করে । এখানে তখন পূর্বজ অন্যান্য হোমো প্রজাতি যথা হোমো ইরেক্টাস, হাইডেলবার্গেন্সিস , ডেনিসোভান, নিয়ান্ডারথালেন্সিস বাস করতো । এই পূর্বজরা তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য আদি ভারতীয়দের জিনোমে দান করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় । এই আদি ভারতীয়রা গঙ্গা উপত্যকায় খ্রিস্টপূর্ব সাত হাজার অব্দের মধ্যে বুনোধান যেটাকে আমরা ওড়া বলি ( এই ওড়া ইতুর সরায় দেওয়া রীতি রয়েছে ) তাকে বার বার কৃষিজাত করে ওরাইজা স্যাটিভা প্রজাতির ধান ও অন্যান্য শস্য চাষে সিদ্ধ হস্ত হয়ে ওঠে । এর অব্যবহিত পর ভারতে প্রবেশ করে ইরাণীয় পশুপালক ও কিছুটা কৃষিকাজ জানা নরগোষ্ঠী । এদেরকে প্রোটো দ্রাবিড়ীয় বলা হয় । এই দুই এর মিলনে ভারতে নিওলিথিক সংস্কৃতি জোতদার হয় । ভারতীয় সংস্কৃতির বুনিয়াদ রচনা করে এরা । ঊত্তর-পশ্চিম থেকে আর্যরা প্রবেশের কিছুটা আগে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে অন্য প্রজাতির ধান ও কয়েক ধরনের মিলেট প্রভৃতি নিয়ে প্রবেশ করে অস্ট্রোএশিয়াটিকরা । ওদের সাথে সাথে প্রবেশ করে তিব্বতীয় বর্মণ ভাষাগোষ্ঠীর লোকেরা । যেহেতু ইতু পূজা নব্যপ্রস্তর যুগীয় ব্রত, তাই আমাদের ইতু নামের উৎস খুঁজতে হবে প্রাগার্য দেশী শব্দের মধ্যে । ইন্দোইউরোপীয় বা আর্য ভাষার মধ্যে এর বীজ থাকবে না ।কন্নড় ভাষায় জন্মানোর প্রতিশব্দ হল ইতু । তামিল ভাষায় ঈতু বলে একটি শব্দ রয়েছে , তারও অর্থ জন্ম দেওয়া এবং ওই ভাষায় ইতু এর অর্থ হল শিশু বা বাচ্চা । দ্রাবিড় ভাষায় ইতুর আদি অর্থ হল জন্মদাত্রী । সুতরাং ইতু পূজাকে আমরা স্বচ্ছন্দে আদিভারতীয়দের প্রজনন ও উর্বরা শক্তি বা প্রজনন ও উর্বরা দেবীর ( পৃথিবী ) পূজা বলতে পারি ।

Advertisement

Imprint
Responsible for the content:
kolkatarsomoy.com
Privacy & Terms of Use:
kolkatarsomoy.com
Mobile website via:
WordPress AMP Plugin
Last AMPHTML update:
17.12.2024 - 16:07:31
Privacy-Data & cookie usage: