ড. রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক
“………. গোস্বামী প্রভু বললেন, “শোন, এখন তো শ্রীকৃষ্ণ গোষ্ঠে চলে গেছেন। এখন আর দেখা হবে না। তুই শান্ত হ তো বাপু।” মহেশ বললো, ” ওহ! গোষ্ঠে গেছেন! তা, গেছেন যখন ফিরবেনও তো। ফেরার সময়ই না হয় দেখা করবো।” গোস্বামী প্রভু বললেন, ” হ্যাঁ, তাই তো ধৈর্য্য ধরতে বলছি। অন্য দিন দেখতে যাস।”
মহেশ–” না , প্রভু , দেখা আমি আজই করবো । তারপরই অন্নজল মুখে নেব। কোন পথে ফেরেন আপনি শুধু সেটা বলুন।” নিরুপায় গোস্বামী প্রভু শেষে বললেন, “এই তো , এখান থেকে বেড়িয়ে হাঁটতে থাকবি। দেখবি এক জায়গায় ডান দিক-বাঁ দিক রাস্তা গেছে। তুই ডান দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকবি। ওই রাস্তাতেই শ্রীকৃষ্ণ ফেরেন।” মহেশ জলটুকু পর্যন্ত পান না করে বেড়িয়ে গেল শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে। তার মনে প্রবল উৎকন্ঠা ,আগ্রহ। ধৈর্য্য আর বাঁধ মানতে চাইছে না। কতক্ষণে দর্শন হবে গোবিন্দের শ্রীবদন এই ভেবে সে আকুল।
অনেক হেঁটে গোস্বামী প্রভুর কথা অনুযায়ী ডান দিকের পথের ধারে দাঁড়িয়ে উৎসুক নয়নে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল ,যাতে যেই না শ্রীকৃষ্ণ আসবেন এ পথে, অমনি দূর থেকেই যেন নজরে পড়ে যায়। কিন্তু, দিন পেড়িয়ে সন্ধ্যা গড়িয়ে আসতে চললো শ্রীকৃষ্ণের দেখা নেই। ক্লান্ত , অবসন্ন, ক্ষুধার্ত দেহে আর সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। পা যেন ভেঙ্গে পড়ছে। অথচ , তবু সে একটু বসলো না পর্যন্ত । ফিরবেই না শ্রীকৃষ্ণের চাঁদবদন না দেখে এই পণ তাঁর। মনে অগাধ বিশ্বাস, গোস্বামী প্রভু যখন বলেছেন , নিশ্চয়ই এপথে শ্রীকৃষ্ণ আসবেন একসময়।
যখন সন্ধ্যা লাগো লাগো হঠাৎ মহেশ দেখল একপাল গরু আসছে । তাদের খুড়েতে গর্ত হয়ে ব্রজের মাটি উড়ছে। চারিদিক ধূলোতে ধূলোতে ভরে যাচ্ছে । মহেশ গভীর আশায় গরুর পালের দিকে তাকিয়ে আছে । এই গরুগুলো নিয়ে তবে বুঝি শ্রীকৃষ্ণ ফিরছেন। শুধু গরু আর গরু । শেষই হয় না , এত-এত তারা সংখ্যায়। চোখ বুজে আসে দেখতে দেখতে । অন্য কেউ হলে হয়তো বা এতক্ষণে চোখ নামিয়ে নিত। কিন্তু, মহেশ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল।কারণ, চোখের পলক ফেলতেই যদি কৃষ্ণ বেড়িয়ে যান, সেই ভয়ে। মহেশ দেখল, গরুর পালের একেবারে শেষ প্রান্তে নবীন মেঘের বর্ণের মত শরীর নিয়ে মুখে ধরা বাঁশী বাজাতে বাজাতে হেঁটে আসছে এক অপূর্ব দর্শন কিশোর । কী অপরূপ সে! কত মায়াভরা বিশাল দু-নয়ন তার। সর্ব শরীরে,চোখে ,মুখে,চুলে ব্রজের ধূলো লেগে। অথচ , সেই ধূলি ধূসরিত অঙ্গেরও কত যেন অদ্ভুত স্নিগ্ধ-উজ্জ্বল লাবণ্য! চোখ যেন আর ফেরানোই যায় না তার থেকে। তার মাথার উষ্ণীষে ময়ূরপুচ্ছ গোঁজা । মহেশের সামনে দিয়ে যেতে যেতে সেই কিশোর আবার আড় চোখে চাইলো তার দিকে । ঠোঁটের কোনে কী মধুর হাসি মাখা !
……(ক্রমশঃ) —–