লেখক – চঞ্চল প্রামাণিক
তখন বসন্তের বিকেলবেলা, নির্জন প্রান্ত। গোপি নগরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনের মাঠে একটি বটবৃক্ষের নিচে জ্ঞাণানন্দ একান্তে বসে কিছু একটা ভাব ছিল, হঠাৎ শুনতে পেল গাছের উপরে পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ। পর্যবেক্ষণ করে দেখল, সেখানে বাবুই, শালিক, ঘুঘু পাখিরা নিজেদের বাসা কে বিপদ থেকে বাঁচানর জন্য ছটফট করছিল কিন্তু দেখা গেল একটি বড় কালো পাখি তাদের ডিম খাওয়ার জন্য হন্য হয়ে পাখিদের ধাওয়া করছিল। পরিশেষে দেখা গেল, ঘুঘু পাখির বাসা থেকে ডিম সংগ্রহ করে ঠোঁটে করে নিয়ে চলে গেল। এরপরও পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ কিছুক্ষণ চলছিল, এটা যেআত্মনিয়ন্ত্রণের এক মহা সংগ্রাম। এইভাবে মানুষের জীবনে আত্মনিয়ন্ত্রণের সমস্যা এবং বর্তমান সরল মানুষের জীবনের একইরকম চিত্রপট সমাজে ঘটে চলেছে। মানুষের জীবনটাও ইট, পাথর, বালির মত বিশেষ পদার্থ দিয়ে তৈরি। শিশু থেকে কিশোর, তরুন, এবং পরিণত মানুষ যখন হয়ে ওঠে। তাঁর কত স্বপ্ন পূরণ করার উদ্দেশ্যে ডানামেলা বাজপাখি মত শিকার ধরার লক্ষ্যে উড়ে বেড়ায়। কিন্তু দেখা যায় তার ভ্ক্ষনের খাবার টি শিয়াল বা কুকুরে সিংহভাগ খেয়ে চলেছে, উচ্ছিষ্ট অংশটি তার ভাগ্যে লাভ হল । এতে শিকারি পাখিটির আত্মতুষ্টি পেল না, নিরুপায় হয়ে নিজেকে মেনে নিল, এটাই তার পাওনা। সেই রকম সুশিক্ষিত যুবকবৃন্দ কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ডানা মেলা পাখির মত ছুটে বেড়ায় জীবনের লক্ষ্যকে স্পর্শ করা। কিন্তু দেখা যায় তার যোগ্যতম জীবিকা অর্জন করতে পারে না। অবশেষে হতাশ জীবন অতিবাহিত হয়। গঠনমূলক জীবনযাত্রা করতে ব্যর্থ হয়, ক্রমশ সিংহভাগ শিক্ষিত যুব সমাজ অবকাশে ম্লান হয়ে পরে ।জ্ঞাণানন্দের জীবনে এই তার উদাহরন। সরকার বাহাদুর গণতন্ত্রকে অটুট রাখার জন্য কতকগুলি জাদুকরি প্রকল্প তৈরি করে মানুষকে সুরাহা দেয়।সাধারন মানুষ তাতেই আকৃষ্ট হয় ,তারা প্রকৃত শিক্ষার মূল্যবোধ বোঝেনা ।সমাজের অশিক্ষিত প্রভাবশালীর অনুগত ব্যাক্তিরা সরকারের অনুকল্যাণ কাজ গুলি ভোগ করে।অনুপযুক্ত যুবকরাই সরকারের কর্মখালি পূরণ করে।যায় ফলে বর্তমান সমাজের দুরবস্থা।এই ভাবনা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিল কখন নিজেই জানে না।এক জন আগন্তুক ব্যাক্তি জ্ঞাণানন্দের পাশ কাটিয়ে যেতে চিনতে পারল,এত! আমার সহপাঠী । তখন সে কাছে আসায় ঘুম ভাঙ্গালো, জ্ঞাণানন্দ হকচকিয়ে উঠে বসল,চোখ কচলাতে কচলাতে আগন্তুক ব্যাক্তিকে দেখে মিষ্টি সুরে বলল,অতুনু!তুই এখানে কি করে আসলি? অতুনু বলল আমি মাঠে যাচ্ছিলাম ধানের ক্ষেতে।চৈতালি ধান কাটতে,মাঠে বাবা এবং আমাদের সহকর্মী হিতেশ কাকু আছেন।তারা দুজনে ধান কাটছে ,আমিও তাদের সহযোগিতা করার জন্য ক্ষেতে যাচ্ছি।অতুনু ও জ্ঞাণানন্দ গোপি নগরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাইমারীতে একইসঙ্গেপড়াশোনা করেছে।প্রাক – প্রাইমারি উত্তীর্ণ পরবর্তী শিক্ষা আলোয়ে অতুনুকে আর দেখা যায়নি। ও চাষীর ছেলে,ওদের সুন্দর জীবন চালানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ আছে , উপযুক্ত চাষ জমি আছে।তার উচ্চ – আকাঙ্খা ওই চাষ জমিতে।কি ভাবে পরবর্তী সময়ে কি ভাবে ভাল চাষ পাবে ,এটাই যথেষ্ট।কিন্তু জ্ঞাণানন্দ শিক্ষিত পরিবারের একজন২৪ বছরের স্নাতক হতবেকার,তার পিতা রঙ্গন বারুই এই বিদ্যালয়ের একসময় প্রধান শিক্ষক ছিলেন ,তিনি এখন প্রাক্তন।তার পিতা বসিরহাট থেকে এই গ্রামে শিক্ষকতা করতে এসেছিলেন।তার বাড়িথেকে কর্মস্থল অনেকটাই দূরত্ব বলে এই গ্রামে বিদ্যালয়ের কাছাকাছি একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। এখানেই 40 বছর চাকুরী করে ১৯৮৯সালে অবসর নিয়ে শহরে চলে যান, কিন্তু জ্ঞাণানন্দের শৈশব জীবন এই গ্রামে কাটলেও ,তার কাছে গ্রাম্য পরিবেশ উপযুক্ত নয়।কারন গ্রাম্য পরিবেশ থেকে একটা সম্পূর্ন মানুষ গড়ে উঠতে পারে না।সব মানুষের জীবনে অনেক উচ্চ আকাঙ্খা থাকে,সেগুলি গ্রাম্য পরিবেশ থেকে পূর্ন করা যায় না, কর্মসংস্থানের সংযোগ শহর থেকেই গড়ে ওঠে।১৬বছর পর জ্ঞাণানন্দ এই গ্রামে প্রথম পা রাখল,,কারন সে পাশের মফস্বল গ্রাম তালদিঘি গ্রামে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা ছিল,পরীক্ষা কেমন হয়েছে সেটা জ্ঞাণানন্দ এর চেয়ে বেশি কেউ যানে না।যদি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়,সেটা ভাগ্যের পরিহাস।তবে উত্তীর্ণ হলেই রেহাই নাই, পকেটে ভারী অর্থ থাকে তবেই বেকারের ক্ষুদা পূরণ করা যায় সে দিক থেকে জ্ঞাণানন্দের পেনশন পিতার সামান্য টাকায় তার পরিবার গুটিসুটি মেরে দিন চলে, অতিরিক্ত খরচ করার কোন উপায় নাই। এখন বড় তার চিন্তা, কিভাবে চাকরি বা অন্য কোন উপার্জনের রাস্তা বার করতেই হবে। এইসব নানা রকমের চিন্তা, ভাবনা তার মাথায় প্রতিনিয়ত আসছে, তাই একটু বিরাম নেওয়ার জন্য স্কুলের প্রাঙ্গণে গাছের নিচে বসে রয়েছে।একটু পরেই বিকেল পার হয়ে সন্ধ্যা নেমে আসবে তাকে বাস ধরতে হবে কিন্তু পুরাতন বন্ধু পেয়ে তার দীর্ঘ দেখা না পাওয়ার এ এক্ অনুভূতি। তাকে পেয়ে অভিনন্দনে জ্ঞাণানন্দ মুগ্ধ হয়ে গেল। তাই সে ঠিক করেছে আজকের রাতটা অতনুর বাড়িতেই কাটাবে, টেলিফোন করার জন্য ও অতুনুকে জিজ্ঞাসা করল কাছাকাছি কোথাও টেলিফোন বুথ আছে কিনা। অতুনুদের বাড়ির নিকটে শ্রীময়ী ক্লাবের পাশে মহিরুল চাচার টেলিফোন বুথ আছে, জ্ঞাণানন্দ অতনুকে বলল, চল বাড়িতে একটা ফোন করে দিই , আজ আমি তোর বাড়িতে রাত কাটাবো। তখন অতনু জ্ঞাণানন্দকে নিয়ে টেলিফোন করতে গেল, ফিরে এসেছে তারা অতনুর বাড়ি পাশের বন্ধু ক্ষিতীশ। তার সঙ্গেও অতনু পরিচয় করে দিল, জ্ঞাণানন্দ জানতে পারল যে ক্ষিতীশের বাবা একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, গ্রামে তার খুব প্রসার। জ্ঞাণানন্দ তখন ভাবল সঠিক লক্ষ্য কষ্ট করে চেষ্টা করলে গ্রাম থেকেও আভিজাত্য ক্যারিয়ার তৈরি করা যায়। যদিও সে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবার থেকে জন্মগ্রহণ করেছে, সেহেতু বংশের ট্র্যাডিশন অব্যাহত রাখার জন্য তাতে গ্রাম ই হোক বা শহরে হোক নিজের লক্ষ্য ঠিক রাখতে হবে। এই ভেবে সে নিজেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো জীবনের ক্যারিয়ার তৈরি করতে গেলে সঠিকভাবে পেশা বেছে নিয়ে সেটার ওপর পড়াশোনা করতে হবে। তাই সে বাড়ি পৌঁছে সিদ্ধান্ত নিল, সে একটা কিছু করবে যা থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করা যায়। হঠাৎ মাথায় আসলো, দেবদেবীর হাতে যে চাঁদ মালা দেওয়া হয়, চাঁদ মালা তৈরি কুটির শিল্প তৈরি করবে। হিসাব করে দেখল এতে অল্প খরচে প্রচুর লাভ হয়। যদিও স্কুল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ভাগ্যে চাকরি যদি হয় তবে ভালো হয় কিন্তু নিজের জীবনকে আরোও প্রসার করতে হলে এই পথই শ্রেয়।এই ব্যবসার পদ্ধতিটা পেয়েছিল যখন সে তার মামার বাড়ি গঞ্জনাপুরের বন্ধু আজাহারুল হকের বাবার একটা বিশাল কাগজের মোড়ক কারখানা আছে। মামার বাড়ি গেলে সেখানে ওই বন্ধুর সাথে কারখানায় যেত বন্ধু আজহারুলের বাবার কাছ থেকে ব্যবসার ছক কিছুটা জেনেছিল। তাই সে কাগজেরমোড়কের ব্যবসার মধ্যে চাঁদ মালা ব্যবসাটাই প্রথমে শুরু করেছিল। এটা একটা সৎ পথে ব্যবসা, এই ব্যবসার মধ্য দিয়েই মধ্যবিত্তের আভিজাত্য জীবনযাপন করা যায় এবং খুব সম্মানীয় ব্যবসা।এরপরে তার দুজন বিশ্বস্ত সহকর্মী মনিরুল এবং ভঞ্জনকে নিয়ে চাঁদ মালার ব্যবসা শুরু করল।তার মায়ের ডাকঘরে জমানো ৫০০০টাকা এবং বাবার কাছ থেকে ৭০০০টাকা ,মোট ১২০০০ টাকা নিয়ে উন্নত ধরনের কাগজ গঞ্জনা পুর থেকে কিনে আনলো। সেই কাগজ সুন্দর করে ভাঁজ করে বিভিন্ন ফুল, তারা, বোতাম আকারে ছোট ছোট করে কাটলো, তারপর একটি পেপার কে কাটিং করে কেটে চাঁদের আকারে বসিয়ে, তারমধ্যে বিভিন্ন রঙিন নকশা কাগজ আটা দিয়ে বসিয়ে দিল এবং কাগজের চারদিকে দেশলাই কাঠি আঠা দিয়ে লাগিয়ে শক্তপোক্ত করল, এরপর প্রতিটি চাঁদের নিচে সোলার ফুল অথবা সোলার বল লাগালো এবং একটার সঙ্গে অন্য চাঁদের সুতো দিয়ে জুড়ে দেয়া হল, এইভাবে পাঁচটি করে চাঁদ নিয়ে একটা মালা তৈরি করে ফেলল। এইভাবে সে পরপর একশটি চাঁদ মালা তৈরি করল, এবার তার ওই চাঁদ মালা সরবরাহ করার জন্য বসিরহাট বাজারে এবং তার পাশাপাশি মফস্বল বাজারগুলিতে অর্ডার নিয়ে আসলো, প্রথম দিনেই তার দেড়শো টি মালার অর্ডার পেল। ডজন হিসেবে তার মালার দাম হল ৪৮ টাকা এতে তার খরচ হয়েছে প্রতিটি মালা পিছু তিন টাকা কুড়ি পয়সা। অতএব ডজন প্রতি ডজন চাঁদমালার লাভ হল ৬ টাকা। এতে সে প্রথমেই বুঝলো খুব লাভজনক ব্যবসা। এইভাবে এই ব্যবসাটি আগ্রহ সাথে করতে লাগলো, আজকের সময়ে তার ১১ বছর ব্যবসা চলছে। এবং চাঁদ মালার সাথে সাথে বিয়ের টোপর,আরো সুন্দর সুন্দর সোলার মোরক তৈরির কারখানা হলো । ব্যবসা আরোও প্রসার হলো,সারা দেশে এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও এই পণ্য রপ্তানি হতে লাগলো। এখন ওই কারখানায় আড়াইশো জন কর্মচারী নিযুক্ত, তাদের প্রত্যেকের বেতন প্রতিদিন সাড়ে ৩৭৫ টাকা। এখন বসিরহাট শহরে জ্ঞাণানন্দ একজন সম্মানী বড় সৎ ব্যবসায়ী বলে পরিচিত। সরকার কর্মের সংস্থান না করতে পারলেও জ্ঞাণানন্দ এর মত একজন সুশিক্ষিত বেকার যুবক তার সুচিন্তিত পরিকল্পনায় অসংখ্য মানুষের কর্মংস্থানের পথ খুলে দিয়েছে এবং তার ব্যবসার সাথে প্রচুর মানুষের বেকারত্ব মুক্ত হয়েছে। এই কারখানার পাশাপাশি অনেক ছোট ছোট খুচরো দোকান গড়ে উঠেছে। ।