সম্প্রতি ভোটের আবহে ভারতবর্ষে অতিধনীদের সম্পত্তির একাংশের পুনর্বন্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ঘটনা হল, অনেকদিন ধরেই অনেক অর্থনীতিবিদ এবং গণনাসংস্থা যে কথা বলে আসছিল — ভারতে সম্পদ ক্রমশঃ আরো বেশি বেশি করে কুক্ষিগত হচ্ছে ধনী এবং অতিধনীদের হাতে। তারা যেমন আরো বড়োলোক হচ্ছে, তেমনি আরো গরীব হচ্ছে বাকি জনতা। যেমন, এই মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে অসমতার তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি এবং অন্যান্যরা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে — অর্থনৈতিকভাবে ধনীতর এক শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে দেশের চল্লিশ শতাংশ সম্পদ। এবং ওই এক শতাংশের হাতে প্রতি বছর জমা হচ্ছে দেশের মোট বার্ষিক আয়-এর বাইশ শতাংশ।এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে ভোটের প্রচারে গিয়ে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী একটি জনসভায় বলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে দেশের সম্পদের সমীক্ষা করবে, এবং সম্পদের পুনর্বন্টন করবে তপশিলি জাতি ও উপজাতি, অন্যান্য পিছিয়ে থাকা বর্গ এবং গরীবদের মধ্যে। যদিও কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারে এর কোনও উল্লেখ নেই। এই কথা বিকৃত করে ২১ এপ্রিল তীব্র সাম্প্রদায়িক আক্রমণ শানান মোদি, রাজস্থানের বংশওয়াড়া-র একটি জনসভায়। দর্শকাসনে উপস্থিত মহিলাদের উদ্দেশ্যে মোদি বলেন, কংগ্রেস আপনাদের মঙ্গলসূত্র, গলার হার খুলে নিয়ে ঘুসপেটিয়া (অনুপ্রবেশকারী) এবং বহু কাচ্চা বাচ্চা হয় যাদের, সেই মুসলমানদের দিয়ে দেবে। এই কথা এর পর উত্তরপ্রদেশের জনসভাতেও পুনরায় বলেন মোদি, কিন্তু তখন মুসলমান শব্দটি শুধু বাদ রাখেন।আমরা এই প্রবন্ধে মোদির সাম্প্রদায়িকতা বা মিথ্যে ভাষণ নিয়ে কিছু বলতে চাইছি না। সেসব নিয়ে অন্যত্র অনেক কথা বলা হয়েছে, নিন্দার স্রোত বয়ে গেছে। নীরব দর্শক নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার সমালোচনা করা হয়েছে। পিটিশন করা হয়েছে। আপাততঃ আমরা আমাদের দেশে অতিধনীদের বিপুল সম্পত্তির আংশিক পুনর্বন্টন নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি, যে ইস্যুটা ভোটের আবহে বিকৃতভাবে হলেও উঁকি দিতে শুরু করেছে।আমাদের দেশে ধনী ব্যক্তিদের সম্পত্তির পরিমাণ কত?
থমাস পিকেটি এবং অন্যান্যদের লেখা রিপোর্ট ‘রাইজ অফ বিলিওনেয়ার রাজ ইন ইন্ডিয়া’ (২০২৪) এর চল্লিশ নম্বর পাতায় এই দুটি টেবিল আছে। টেবিল দুটিতে ভারতে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অর্থনৈতিক বর্গ হিসেবে সম্পত্তি ও বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ও তার অনুপাত দেখানো হয়েছে।পিকেটিদের সমীক্ষা অনুয়ায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ মাস অব্দি আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ৯২ কোটি ২৩ লক্ষ ৪৪ হাজার ৮৩২ জন। তার মধ্যে সবচেয়ে ধনী ০.০০১ শতাংশ হল অতিধনী। অর্থাৎ, আমাদের দেশে অতিধনী ৯ হাজার ২২৩ জন। কমপক্ষে কত টাকার তুল্য মোট সম্পদের মালিক হলে এই অতিধনীদের মধ্যে আসতে পারা যায়? কমপক্ষে প্রায় ২৭৫ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকার তুল্য সম্পত্তির মালিক হলে। ঊর্ধসীমা নেই। তা এদের মধ্যেও সম্পত্তির পরিমাণের কম বেশী আছে, এই অতিধনীদের গড় সম্পত্তির পরিমাণ ২২৬১ কোটি ৩৪ লক্ষ টাকার মতো। তাহলে এই অতিধনীদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ কত? গুণ করলেই পাওয়া যাবে। ২০৮ লক্ষ কোটি টাকার চেয়েও বেশি। [বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? আচ্ছা, একজনের উদাহরন দিই। আম্বানি আদানিরা তো আছেনই। উদাহরন হচ্ছেন অমিতাভ বচ্চন। নিজের ৩১৬০ কোটি টাকার সম্পত্তি। সম্প্রতি উইল করেছেন, মারা গেলে ছেলে মেয়ে অভিষেক বচ্চন আর শ্বেতা বচ্চন সমানভাবে পাবেন এই সম্পত্তি। প্রায় ১৬০০ কোটি করে একেকজন। অতএব, উনারা যদি কপর্দকহীনও থাকেন এখন, বাবা মারা যাবার পর উনারা অতিধনী হয়ে যাবেন।]তর্কের খাতিরে ধরে নিই, বছর বছর এদের আয় কেবলমাত্র দীর্ঘমেয়াদী আমানতে সুদ (৭%) থেকে। এবং ধরা যাক, আমানতি সুদ-এ আয় এর ওপর এই ট্যাক্স চাপানো হচ্ছে না আপাততঃ, যেহেতু এটা সম্পদ-কর। তাহলে এদের কাছ থেকে প্রতি বছর যদি এদের সম্পদের অর্ধেক (৫০% বা ০.৫) সরকার নিয়ে নেয় তাহলে কী দাঁড়াবে? এদের মধ্যে সবচেয়ে কম ধনী যে, অর্থাৎ যার সম্পদের পরিমাণ ২৭৫ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকা প্রায়, তার সম্পত্তির পরিমাণ পাঁচ বছর পরে দাঁড়াবে ২৭৫.৬৭ কোটি x(১ – ০.৫x(১ – ০.০৭) – ০.৫x০.৫x(১ – ০.০৭) – ০.৫x০.৫x০.৫x(১ – ০.০৭) – ০.৫x০.৫x০.৫x০.৫x(১ – ০.০৭) – ০.৫x০.৫x০.৫x০.৫x০.৫x(১ – ০.০৭)) = ২৭ কোটি ৩১ লক্ষ টাকার মতো। অর্থাৎ, সে তখনও বেশ ধনী। আর শুধু তার কাছ থেকেই সরকার পাঁচ বছরে এভাবে আদায় করবে ২৭৫.৬৭ কোটিx(০.৫ + ০.৫x০.৫ + ০.৫x০.৫x০.৫ + ০.৫x০.৫x০.৫x০.৫ + ০.৫x০.৫x০.৫x০.৫x০.৫) = ২৬৭ কোটি টাকা।তাহলে এই ৯ হাজার ২২৩ জন অতিধনীদের সবার কাছ থেকে মোট কত আয় করবে? ২০৮ লক্ষ কোটিx(০.৫ + ০.৫x০.৫ + ০.৫x০.৫x০.৫ + ০.৫x০.৫x০.৫x০.৫ + ০.৫x০.৫x০.৫x০.৫x০.৫) = ২০১.৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো। প্রথম বছরে ১০৪ লক্ষ কোটি, তার পরের বছরে ৫২ লক্ষ কোটি, তার পরের বছরে ২৬ লক্ষ কোটি, তার পরের বছরে ১৩ লক্ষ কোটি, তার পরের বছরে সাড়ে ৬ লক্ষ কোটি টাকা। ৭ শতাংশ বার্ষিক আমানতি সুদ ধরলে, এবং প্রতি বছর এই টাকা থেকে খরচ সমান হচ্ছে ধরলে (অর্থাৎ প্রথম চার বছর যার পরিমাণ বার্ষিক ৪০ লক্ষ কোটি টাকার মতো, পঞ্চম বছরে যা পড়ে থাকবে পুরোটা), প্রথম বছর সুদ পাওয়া যাবে ১০৪ – ৪০ = ৬৪ লক্ষ কোটি টাকার ৭ শতাংশ, মানে ৪.৫ লক্ষ কোটি টাকা। দ্বিতীয় বছর ৬৪ + ৫২ + ৪.৫ – ৪০ = ৮০.৫ লক্ষ কোটি টাকার ৭ শতাংশ, মানে ৫.৬ লক্ষ কোটি টাকা। তৃতীয় বছর সুদ পাওয়া যাবে ৮০.৫ + ২৬ + ৫.৬ – ৪০ = ৭২.১ লক্ষ কোটি টাকার ৭ শতাংশ, মানে ৫ লক্ষ কোটি টাকা। চতুর্থ বছর সুদ পাওয়া যাবে ৭২.১ + ১৩ + ৫ – ৪০ = ৫০.১ লক্ষ কোটির ৭ শতাংশ, মানে ৩.৫ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট সুদ যোগ করলে অতিধনীদের (অর্থাৎ, প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ধনীতর ০.০০১%) কাছ থেকে পাঁচ বছরে আদায় হওয়া টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ২০১.৫ + ৪.৫ + ৫.৬ + ৫ + ৩.৫ = ২২০ লক্ষ কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছরে ২০১.৫ লক্ষ কোটি আদায়, ১৮.৫ লক্ষ কোটি তার সুদ। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে মোটমাট @৯% সুদ।
কিএরপর আসছে যারা ভীষণ-ধনী (অর্থাৎ, প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ধনীতর ০.০১%) কিন্তু অতিধনী নয়।ন্তু অতিধনী নয়। ধরা যাক, তাদের সম্পত্তির সিকিভাগ (২৫% বা ০.২৫) করে বছরে সম্পদ-কর হিসেবে নেওয়া হল; এবং, যারা বেশ-ধনী (অর্থাৎ, প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ধনীতর ০.১ শতাংশ) কিন্তু ভীষণ-ধনী কিংবা অতিধনী নয়, তাদের সম্পত্তির দশ ভাগের এক ভাগ (১০% বা ০.১) করে বছরে আদায় করল সরকার। তাহলে সরকারের হাতে পাঁচ বছরে কত ফান্ড জমা হয়?পিকেটিদের রিপোর্ট অনুসারে, আমাদের দেশে ভীষণ-ধনীর সংখ্যা ৯২,২৩৪ – ৯,২২৩ = ৮৩,০১১ জন। এবং, কমপক্ষে ৩৬ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকার তুল্য পরিমাণ সম্পত্তি থাকলে, কিন্তু তা আবার ২৭৫ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকার কম হতে হবে, তবে সে ভীষণ-ধনীর তালিকায় ঢুকবে। [উদাহরন, ভারতীয় ক্রিকেট দলের বর্তমান অধিনায়ক রোহিত শর্মা, যার সম্পত্তির পরিমাণ ২১৬ কোটি টাকা]। পিকেটিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হিসেব করলে পাওয়া যায়, এদের সম্পত্তির মোট পরিমাণ ৯২,২৩৪৩০০ কোটি – ৯,২২৩২,২৬১ কোটি = ৬৮ লক্ষ কোটি টাকার মতো। এদের থেকে যদি বছরে পঁচিশ শতাংশ মতো সম্পত্তি-কর সরকার আদায় করে, তাহলে পাঁচ বছরে মোট আদায় হবে ১৬.৯৬ + ১২.৭২ + ৯.৫৪ + ৭.১৫ + ৫.৩৭ = ৫২ লক্ষ কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছরে এর সুদের পরিমাণ দাঁড়াবে (আগের হিসেব মতো পাঁচ বছরে মোটমাট সুদ @৯% ধরলে) ৪.৭ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ ভীষণ-ধনীদের থেকে সরকারের পাঁচ বছরে মোট আয় হবে ৫৬.৭ লক্ষ কোটি টাকা।একইভাবে বেশ-ধনীদের থেকে প্রতি বছর সম্পত্তির দশ শতাংশ করে আদায় করলে সরকারের পাঁচ বছরে কত আয় হবে? পিকেটির রিপোর্ট অনুসারে, আমাদের দেশে বেশ-ধনীর সংখ্যা ৯,২২,৩৪৫ – ৯২,২৩৪ = ৮ লক্ষ ৩০ হাজার ১১১ জন। এবং, এদের সম্পত্তি সওয়া পাঁচ কোটি টাকার ওপরে কিন্তু ৩৬ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকার নিচে। [উদাহরন, প্রায় সওয়া ন’ কোটি টাকার সম্পত্তি থাকা প্রাক্তন ক্রিকেটার অশোক দিন্দা]। পিকেটিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হিসেব করলে দেখা যায়, এই বেশ-ধনীদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৯,২২,৩৪৫৪০ কোটি – ৯২,২৩৪৩০০ কোটি = ৯৩ লক্ষ কোটি টাকার মতো। এদের থেকে যদি বছরে দশ শতাংশ মতো সম্পত্তি সরকার আদায় করতে থাকে, তাহলে পাঁচ বছরে মোট আদায় হবে ৯৩x(০.১ + ০.৯x০.১ + ০.৯x০.৯x০.১ + ০.৯x০.৯x০.৯x০.১ + ০.৯x০.৯x০.৯x০.৯x০.১) = ৩৮ লক্ষ কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছরে এর সুদের পরিমাণ দাঁড়াবে (আগের হিসেব মতো পাঁচ বছরে মোটমাট সুদ @৯% ধরলে) ৩.৪ লক্ষ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ, বেশ-ধনীদের থেকে সরকারের মোট আয় হবে পাঁচ বছরে ৪১.৪ লক্ষ কোটি টাকার মতো।
অর্থাৎ, অতিধনী (দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ধনীতম ০.০০১ শতাংশ ব্যক্তি), ভীষণ-ধনী (দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ধনীতর ০.০১ শতাংশ ব্যক্তি কিন্তু যারা আবার অতিধনী নয়), এবং বেশ-ধনী (দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ধনীতর ০.১ শতাংশ ব্যক্তি কিন্তু যারা আবার ভীষণ-ধনী বা অতিধনী নয়) — এদের কাছ থেকে যথাক্রমে সম্পত্তির অর্ধেক, সিকিভাগ এবং দশভাগের এক ভাগ প্রতি বছর আদায় করলে পাঁচ বছরে সরকারের হাতে আসে খরচযোগ্য ২২০ + ৫৬.৭ + ৪১.৪ = ৩১৮ লক্ষ কোটি টাকার মতো।
প্রসঙ্গতঃ, আমাদের দেশের বার্ষিক বাজেট প্রায় ৪৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছরের বাজেট ২২৫ লক্ষ কোটি টাকা।
এবার আসুন দেখা যাক, পাঁচ বছরে অতিরিক্ত এই ৩১৮ লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে সরকার কী কী করতে পারে?
সর্বজনীন পুষ্টি
আমাদের দেশে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য দেওয়া হয় রেশন-এ। তাতে খরচ হয় বছরে ২ লক্ষ কোটি টাকার মতো। যদি খাদ্যশস্যের সাথে একটা পরিমাণ দানাশস্যও দেওয়া হতো, তাহলে ধরা যাক আরো ১ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হত। এর সাথে যদি ভোজ্য তেল-ও বিনামূল্যে দেওয়া হতো তাহলে ধরা যাক মোটের ওপর আরও ১ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হতো। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে মোট ২০ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হত ষাট শতাংশ মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য, দানাশস্য এবং ভোজ্য তেল দিতে। ধরা যাক, এর আওতায় ৯০ শতাংশ মানুষকে আনা হল। তাহলে খরচা হত দেড় গুণ। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে ৩০ লক্ষ কোটি টাকা।
সর্বজনীন পাকা বাসা
হিসেব বলে, আমাদের দেশে ৬০ শতাংশ পরিবারের আলাদা রান্নাঘর, বাথরুম, পায়খানা, ও নিকাশি বিশিষ্ট পাকা ঘর আছে। কিন্তু ৪০ শতাংশ পরিবারের তা নেই। আমাদের দেশে গড়ে সওয়া চারজনে একটা পরিবার ধরলে ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে পরিবারের সংখ্যা ৩০ কোটির একটু বেশি। তার চল্লিশ শতাংশ মানে ১২.২ কোটির মতো। তাদের রান্নাঘর, বাথরুম, পায়খানা ও নিকাশি বিশিষ্ট পাকা ঘর তৈরি করে দিতে আনুমানিক পাঁচ লক্ষ টাকা করে যদি খরচ হয়, তাহলে মোট খরচ ৬১ লক্ষ কোটি টাকা।
সর্বজনীন স্কুল শিক্ষা
আমাদের দেশে সরকারি স্কুল শিক্ষায় সবচেয়ে এগিয়ে দিল্লি। দিল্লির সরকারের এই কারণে খরচ হয় বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকার মতো। দিল্লির জনসংখ্যা ৩ কোটি ৩০ লক্ষ। অর্থাৎ, স্কুল শিক্ষায় জনপিছু (সাবধান! ছাত্রপিছু নয়) দিল্লি সরকারের বছরে খরচ ৫১৫১.৫১ টাকা। দিল্লিতে মোট স্কুল পড়ুয়ার ৪০ শতাংশ মতো সরকারি স্কুলে পড়ে। যদি ধরে নেওয়া হয়, পরিকাঠামো পর্যাপ্ত হলে এবং শিক্ষার মান পর্যাপ্ত হলে ৯০ শতাংশ পড়ুয়া সরকারি স্কুলেই পড়বে, তাহলে দিল্লিতে সরকারের জনপিছু স্কুল শিক্ষায় খরচ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ১১,৫৯০ টাকা বছরে। সারা ভারতে যদি এই পরিমাণ খরচকেই স্কুল শিক্ষায় মান্য সরকারি খরচ ধরা হয়, তাহলে ১৩০ কোটি জনসংখ্যার জন্য বছরে খরচ দাঁড়ায় ১৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছরে তা হবে ৭৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা
আমাদের দেশে সরকারি জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতেও দিল্লি সরকার সবচেয়ে এগিয়ে। তাদের খরচ হয় বছরে ৯ হাজার কোটি টাকার মতো। দিল্লিতে প্রায় ৪৭ শতাংশ মানুষ শুধুমাত্র সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা-ই নেয়। যদি এটা বেড়ে নব্বই শতাংশ হয়, তাহলে খরচ দাঁড়ায় ১৭ হাজার কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ, তিন কোটি তিরিশ লক্ষ জনংখ্যার দিল্লিতে জনপিছু বছরে ৫১৫১.৫১ টাকা খরচ করলে ৯০ শতাংশ মানুষকে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার আওতায় আনা সম্ভব। সারা ভারতের ক্ষেত্রে এটা দাঁড়ায় ৬ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছরে দাঁড়ায় ৩৩ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা।
সর্বজনীন বিদ্যুৎ
হিসেব বলে, আমাদের দেশে যদি নব্বই শতাংশ গৃহস্থ বাড়ির বিদ্যুতের বিল নিঃশুল্ক করতে হয়, তাহলে বছরে খরচ হয় বাজেটের চার শতাংশের মতো। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে কুড়ি শতাংশের মতো। দেশের বার্ষিক বাজেট ৪৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো, অর্থাৎ সর্বজনীন বিদ্যুৎ খাতে পাঁচ বছরে খরচ মোট ৯ লক্ষ কোটি টাকার মতো।
সর্বজনীন গণপরিবহন
আমাদের দেশে গণপরিবহন বলতে ট্রেন বাস স্টিমার ইত্যাদি। এখন ট্রেন আর ক্ষতিতে চলে না, প্রায় একশ’ শতাংশ অপারেটিং রেশিও-তে চলে। ফলে ধরে নেওয়া যায়, টিকিট-এ কোনও ভর্তুকি দেওয়া হয় না। ট্রেন -এ অসংরক্ষিত টিকিট বেচে রেল-এর আয় হয় বছরে ১৪.৬ হাজার কোটি টাকার মতো (২০২২-২৩ অর্থনৈতিক বর্ষের হিসেব)। যদি ট্রেনের অসংরক্ষিত ভাড়া মুকুব করে দেওয়া হয়, তাহলে মানুষ পয়সা খরচ এবং টিকিট কাটার হ্যাপা থেকে বাঁচে। সংরক্ষিত টিকিট বেচে রেলের বছরে আয় হয় আরো ৪৮.৭ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে শুধু স্লিপার এবং এসি থ্রি টায়ার টিকিট বেচে আয় যদি ধরে নিই এর অর্ধেক, অর্থাৎ ২৪.৪ হাজার কোটি টাকার মতো; তাহলে ২৪.৪ + ১৪.৬ = ৩৯ হাজার কোটি টাকা খরচ করলে ট্রেনের এসি থ্রি টায়ার অবদি ভাড়া মুকুব করা যেতে পারে। পাঁচ বছরে তা দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। ধরা যাক, একই পরিমাণ খরচ হবে বাসের ক্ষেত্রেও। তাহলে পাঁচ বছরে প্রায় ৪ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করলে এসি থ্রি টায়ার অবদি ট্রেন যাত্রা এবং সমস্ত ধরনের বাসযাত্রা নিঃশুল্ক করে দেওয়া সম্ভব।
সর্বজনীন টেলিযোগাযোগ
আমাদের দেশে যতখুশি ফোন, এসএমএস, এবং দৈনিক ২ জিবি ইন্টারনেট ডাটা -র বাৎসরিক খরচ খুব বেশি হলে ৩০০০/- র মতো। যদি দেশের ৯২ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের সবারই স্মার্ট ফোন থাকে, তাহলে তাদের মোট এইবাবদ বাৎসরিক শুল্ক ২ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ বছরে ১৩ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এটা নিঃশুল্ক করে দেওয়া সম্ভব।
অর্থাৎ পুষ্টি, পাকা বাসা, স্কুল শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, বিদ্যুৎ, গণপরিবহন, এবং টেলিযোগাযোগ — এগুলি যদি সর্বজনীন হয়; অর্থাৎ দেশের নব্বই শতাংশ মানুষের জন্য নিঃশুল্ক হয় — তাহলে পাঁচ বছরে মোট খরচ হয় ৩০ + ৬১ + ৭৫ + ৩৩.৫ + ৯ + ৪ + ১৩.৮ = ২২৬ লক্ষ কোটি টাকার মতো।
অর্থাৎ, এইগুলো নিশ্চিত করার পরও সরকারের হাতে পাঁচ বছরে ৯২ লক্ষ কোটি টাকা পড়ে থাকে।
সেই টাকায় প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের ৯০ শতাংশ কে (৪০ কোটির মতো) বছরে কুড়ি হাজার টাকা করে দেওয়া সম্ভব। তাতে খরচ পাঁচ বছরে ৪০ লক্ষ কোটি টাকা।
বেকার ও প্রায়-বেকার (৮ কোটি) এবং ৯০ শতাংশ ষাটোর্ধ মানুষকে (১২ কোটি : আমাদের দেশে জনসংখ্যার দশ শতাংশ ষাটোর্ধ) বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দেওয়া সম্ভব। তাতে পাঁচ বছরে ৫০ লক্ষ কোটি টাকা খরচ।
না, সম্পত্তি পুনর্বন্টনের জন্য সচ্ছল মধ্যবিত্ত তো নয়ই, এমনকি ধনীদের (দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ধনীতর ১% ব্যক্তি, কিন্তু যারা অতিধনী বা ভীষণ-ধনী বা বেশ-ধনী নয়) সম্পত্তিতেও হাত দেওয়ার দরকারই নেই। শুধু অতিধনী, ভীষণ-ধনী ও বেশ-ধনীদের সম্পত্তির যথাক্রমে অর্ধেক, সিকিভাগ ও দশমাংশ আদায় করলেই এগুলো সম্ভব।