google-site-verification=r3lYzE3jI5XC8igrXRKdm9HAWALrzmx6coPmyeHNww4
Spread the love

লেখক – সায়ন রায়

গবেষক সাগর চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে ভারতীয় সুন্দরবনের অনেক অজানা,অচেনা গ্রামের শিল্পসম্পদ ও সেইসঙ্গে অনেক অচেনা,অপরিচিত শিল্পীদের খুঁজে পেয়েছি৷ খুঁজে পেয়েছি আরো অনেক নতুন অচেনা গ্রাম,অজানা শিল্পীদের ও তাদের শিল্পকর্মের উদাহরণ৷ আমার একটি লিখিত নিবন্ধ – ‘সুন্দরবনের এক পাথরখোদাই শিল্পীর কথা’ ইতিমধ্যেই Google Website এ প্রকাশিত হয়েছে৷ সেই শিল্পীকে খুঁজে পেয়েছিলাম ২০২২ এর গ্রীষ্মের কোন এক পড়ন্ত মধ্যাহ্নে৷ ভারতীয় সুন্দরবনের এহেন পরিশ্রমী, ধৈর্য্যশীল বৃদ্ধ শিল্পী মধুসূদন বৈদ্য, প্রায় আশি ছুঁইছুঁই বয়সে এসেও তাঁর হাতের পাথরখোদাইয়ের দক্ষতা আমায় মুগ্ধ করেছিল৷ তাকে নিয়ে লিখেছিলাম প্রসেনজিৎ-দার(প্রসেনজিৎ দত্ত) অনুরোধে৷ ভারতীয় সুন্দবনের অনেক আজানা লোকজ কারুশিল্পীদের পরিচয় আমরা আজও পাইনি৷ অনেক অজ্ঞাত, অপরিচিত শিল্পী ও তাদের শিল্পকর্মগুলি নগর সভ্যতার আলোয় এসে দাঁড়ায় নি৷ তাই ভারতীয় সুন্দরবনের লোকশিল্পীদের বিরাট চলতি বাজারের একটা ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে! থেকেই যাচ্ছে তাদের প্রতি একটা দায়ভার ও দায়িত্ববোধ!

 সাগর চট্টোপাধ্যায় দক্ষিণ ও উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার পুরাকীর্তি বিষয়ক কাজ করার সুবাদে সুন্দরবনের বেশকিছু পল্লী, ব্লক, প্লট ও লাট জমি ধরে ধরে লোকশিল্পীদের খুঁজে পেয়েছেন৷ তাঁর গবেষণাতে তিনি উপলব্ধি করেছেন যে ভারতীয় সুন্দরবনের মৃৎশিল্পীর সংখ্যা প্রচুর, কিন্তু মৃৎ- পুতুল শিল্পীর সংখ্যা একেবারেই নগণ্য! এই সংখ্যাও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে এই সংখ্যার গুণতিতে শূন্য আসলে অবাক হবার কিছু থাকবে না৷ 

কিন্তু আমি মনেকরি,সুন্দরবনের মৃৎ-পুতুল শিল্পকর্মকে বাঁচিয়ে রাখা তখনই সম্ভব, যখন তাদের নিজস্ব চলতি বাজার গড়ে তোলা সম্ভব হবে৷ কিন্তু কি ভাবে তা সম্ভব? প্রশ্ন আপনাদের কাছে ছুঁড়ে দিলাম!

বর্তমানে অনেক শিল্পীরাই নিজের তাগিদে এক প্রকার স্ব-ইচ্ছা থেকে মৃৎ-পুতুল তৈরীর কাজকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন৷ তারা তাদের নিজস্বধারা অর্থাৎ স্বতন্ত্রতা টিকিয়ে রাখতে চান তাদের শিল্পকর্মের মধ্যদিয়েই৷ তারা ভুলেও ভাবেননি কৃষ্ণনগরের মতো হাল ফ্যাশানের চলতি বাজার থেকে প্লাস্টার অপ প্যারিসের মোটা অঙ্কের ছাঁচ কিনে এনে সেই ছাঁচ ব্যবহার করে পুতুল গড়বেন! এমনই একটি বড়ো উদাহরণ হল, হাড়োয়া থানার নজরনগর গ্রামটি(জে.এল নং – ২৬)৷ সেই গ্রামের শিল্পীরা প্রত্যেকেই প্রায় মাটির পুতুল তৈরীর কাজকে গর্বের সাথে বরণ করে নিয়েছেন৷ সেইগুলি তারা বিক্রি করেন চৈত্র সংক্রান্তির চড়কের মেলায়, মেলাটি বসে লাল মসজিদের পাশে৷ লাল মসজিদ একটি প্রত্নস্থল, যার চারিধারে প্রত্নবস্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে৷ এককালের বালান্দা বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসস্তুপ(?) যাকে স্থানীয়রা লাল মসজিদ বলেই জানেন৷ এই লাল মসজিদের পাশেই নজরনজরের মৃৎশিল্পীরা তাদের মৃৎপুতুলের পসরা সাজিয়ে নিজস্বী বাজার গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন৷ বছরের একটি মাত্র দিনে এক বেলার মেলা এটি, দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হয়৷ এখানে কৃষ্ণনগর ঢোকেনি, বলা বাহুল্য ঢুকতে দেয়নি নজরনগর৷ বর্তমানে মাটির পুতুলের চাহিদা কমেছে, সেই জায়গা দখল করেছে প্লাস্টিকের খেলনা- সামগ্রি৷ তা সত্ত্বেও নজরনগর তার মৃৎ-পুতুল শিল্পকর্মকে বাঁচিয়ে রেখেছে৷ যাই হোক আমি এই নিবন্ধে যেই মৃৎ- পুতুল শিল্পীকে নিয়ে আলোচনা করতে বসেছি তিনি তাঁর জীবনের মধ্যগগণে উপনীত হয়ে, কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃত্যুর কাল আবহকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জয়ের পতকা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন৷ এগিয়ে নিয়ে গেছেন মৃৎ- পুতুল শিল্পকর্মকে৷ একটি স্বপ্নই তাকে এক প্রান্ত থেকে টেনে কোথায় নিয়ে চলে গেলেন, বুঝে উঠতে পারলেন না! সেই কঠিন বাস্তবের চিত্রই সেদিনের পড়ন্ত দুপুরে শিল্পী স্বপন বাবু আমাদের দুজনকে ব্যক্ত করছিলেন৷ গ্রামের নাম কলাতলা, ৫ নং ভুবনখালি, কুলতলি থানার বাসিন্দা স্বপন চৌধুরী৷ জয়নগর – ঢাকি রোডে দয়ালের মোড় (২৬কিমি), সেখানে নেমে স্বপন বাবুকে সকলে চেনেন, যার একটি হাতে নেই, এই তার পরিচয়৷ ডান হাতটি কাঁধ থেকে পুরোটাই বাদ দেওয়া হয়েছে৷ বায়োপ্সির রিপোর্টে ক্যানসার ধরা পড়ে৷ তড়িঘড়ি অস্ত্রোপচারে ক্যানসারকে আটকানো গেলেও আটকানো যায়নি বাঁ হাতের অবিশ্বাস্য কারুকাজ৷ শুধু বাঁ হাতের সাহায্যে মাটির এমন রঙিন পুতুল, ঠাকুর- দেবতার ছোটো বড়ো মূর্তি ও মাটির জীবজন্তু তৈরীতে সিদ্ধহস্ত স্বপন চৌধুরী৷ কখনও ছাঁচ দিয়ে পুতুল গড়বেন তা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না! শারীরিক অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এক হাতের জোড়েই এতো সুন্দর শিল্পকর্ম! লোকশিল্পের পরম্পরার কথা যদি বলি, বংশানুক্রমিক জীবিকার কথা যদি ধরি তাহলে কোনোটাই তাঁর নামের সাথে খাটে না৷ বংশানুক্রমিক ভাবে বা পারিবারিক সূত্রধরে তার এই জীবিকায় প্রবেশ হয়নি৷ এই জীবিকায় আসার পেছনে ছিল একটা দূর্ঘটনা।একটা মারণ রোগ৷
সেই মারণ রোগ তার অর্ধজীবনকে কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু দিয়ে গেছে তার নতুন জীবন, নতুন ভবিষ্যৎ৷ মৃৎ-পুতুল শিল্পকর্ম সুন্দরবনের এক বিরল জীবিকা৷ বর্তমান প্রজন্মের হাত ধরে এই জীবিকাকে লোকশিল্পের আঙ্গীকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন কি স্বপন চৌধুরী? ছেলেকে তৈরী করে যাচ্ছেন, এই লাট অঞ্চলে পড়া-লেখা শিখেও কি কাজ পাবে, তার চোখে মুখে আশঙ্কার প্রশ্ন! সুন্দরবনেই জন্ম তাঁর, সুন্দরবনে বেড়ে ওঠা, প্রথম জীবনে কৃষিকাজ, পরবর্তীতে মাটির পুতুল ও ঠাকুর নির্মান করছেন স্বপন চৌধুরী৷
-কি কি পুতুল আপনি তৈরী করেছেন এ পর্যন্ত?
–আমি মূলত জীবজন্তুর পুতুলই বেশি তৈরী করি৷
যেমন – বাঘ, সিংহ, হরিণ,শিয়াল, তিমি, গরু, ষাঁড়, কুমির, সাপ, টিয়াপাখি, ময়ূর, বিভিন্ন মনীষী আর দেব-দেবীর ছোটো ও বড়ো মূর্তি৷
আসলে পাড়ার ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা আসে তাদের স্কুলের পরীক্ষার জন্য পুতুল তৈরী করাতে৷ কখনো তারা পয়সা দেয়, আবার কখনো এমনই নিয়ে চলে যায়, পয়সা করি সেভাবে পাওয়া যায় না৷ এই লাট অঞ্চলে কেই বা বেশি পয়সা দেবে!
-আর ঠাকুর দেবতার বড়ো মূর্তি?
— হ্যাঁ, সেগুলিতে পয়সা বেশি আসে, বড়ো মূর্তির অর্ডার বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসে৷
–আমার ঠাকুর যায় নিমপীঠে, তুলসীঘাটা, কুলতলীতে, কাঁটামারি আরো বিভিন্না জায়গায়৷

  • আপনি এক হাতে কিভাবে বড়ো মূর্তি বানান?
    — পুতুল গুলির ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয় না৷ তবে বড়ো মূর্তির ক্ষেত্রে অসুবিধে হয়৷ খড় আর দঁড়ি দিয়ে কাঠামো তৈরী করার সময় আমার স্ত্রী সান্ত্বনা সাহায্য করে৷ বাকিটা আমি নিজেই সামলাই৷
    –আমি কোনো ছাঁচ ব্যবহার করি না,বললেন স্বপন বাবু৷
  • তাহলে কিভাবে বড়ো মূর্তি বা পুতুল তৈরী করেন?
    — মাটির তাল থেকে ওই এক হাতেই যে কোনও পুতুল তৈরী করে তা রোদ্দুরে শুকিয়ে রং করি৷ ‘পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ’ স্বপন চৌধুরীকে অভাবে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল৷ বাবাকে সঙ্গ দিতে মাটি কাটা, চাষাবাস , বাগানের কাজে প্রবেশ৷ সেই থেকেই তার জীবনে মাটির ভূমিকা অনেক, মাটির প্রতি তার ভালোবাসা৷ মাত্র এক হাতে অসম্ভব পরিশ্রম করলেও বুঝতে দেয়নি কাউকে অভাবের সংসার৷ ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়েছেন৷ বড়ো মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন৷ ছোটো মেয়েকে কলেজে পাঠিয়েছেন৷ ভারতীয় সুন্দরবনের এই দরিদ্র প্রতিবন্ধী মৃৎ-লোকশিল্পীকে খুঁজে পেয়েছিলেন সাগর বাবু (গবেষক – সাগর চট্টোপাধ্যায়)৷
    কলকাতার একটি বাংলা সাহিত্য, লোক সাংস্কৃতিক গ্রুপ “সিসৃক্ষা” যাদের বৈশাখী সাংস্কৃতিক মঞ্চে(২৪/০৪/২০২২)তারিখ উপস্থিত ছিলেন শ্রী স্বপন চৌধুরী৷ ভারতীয় সুন্দরবনের একজন প্রতিবন্ধী দক্ষ মৃৎ-শিল্পী হিসেবে তার হাতে সন্মাননা জ্ঞাপন করে,স্মারক তুলে দিয়েছিলাম আমরা।সেই সন্মাননা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ‘সিসৃক্ষা’ গ্রুপের প্রধান কর্ণধার শ্রীমতি প্রিয়া সারাদ,গবেষক শ্রী সাগর চট্টোপাধ্যায়,মানিক রায়,দিপালী রায়,সত্যজিৎ সেন চৌধুরী, বাপ্পাদিত্য পাইক,সাবেরী মন্ডল আরো অসংখ্য লেখক লেখিকা, অধ্যাপক অধ্যাপিকা, বিশিষ্ট কবি , গবেষক ও অসংখ্য গুনীজনেরা৷ স্বপন চৌধুরী-ই শুধু শেষ কথা নয়৷ তার মত অসংখ্য লোকশিল্পীরা আজ তাদের নিজেদের ঐতিহ্যকে হারাতে বসেছে, হারাচ্ছে তাদের শিল্পকর্মগুলি৷ নগরসভ্যতা ও উন্নয়ণের সাথে সাথে আমরাই তাদের বিরল করে তুলছি! সতর্ক হন, লোকশিল্পের অপার ঐতিহ্যকে বাঁচান৷

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি ও পত্র-পত্রিকা

১| সুন্দরবনের কারুশিল্প ও কারুশিল্পী, সাগর চট্টোপাধ্যায়,
২| লোকশ্রুতি, সুন্দরবনে,এক মৃৎ-শিল্পীদের গ্রামে, সাগর চট্টোপাধ্যায়, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ সরকার

বিশেষ কৃতজ্ঞতা – মানব মন্ডল ও আকাশ বিশ্বাস৷

শিল্পী স্বপন চৌধুরীর ফোন নং – ৯৬৪১৭৭১৮৪৪
লেখকের ফোন নং – ৬২৯০৫১৭৪৬৭

One thought on “সুন্দরবন – এর এক প্রতিবন্ধি মৃৃৃৎ-পুতুল শিল্পীর কথা”
  1. ভীষন সমৃদ্ধ হলাম । এমন মানুষ ও আছে জানতে পেরে খুব ভালো লাগলো । খুব সুন্দর লেখা ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights