বিশ্বজিৎ সরকার
যে সময় তাঁর বিশ্বনন্দিত হওয়ার কথা‚ সে সময় তিনি ঝুলছিলেন সিলিং ফ্যান থেকে!
১৯ জুন, ১৯৮১। স্কুল শেষে ঘরে ফিরছিলেন শিক্ষিকা নমিতা মুখোপাধ্যায়। কলকাতার দক্ষিণ অ্যাভিনিউয়ে ছয় তলার এক ফ্লাটে ডাক্তার স্বামীর সাথে থাকতেন তিনি। পেশাগত কারণে তার স্বামী বেশ কিছুদিন ধরেই মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। কিন্তু ঘরে ঢোকার সাথে সাথে নমিতা যা দেখলেন তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। ঘরে গিয়ে আবিষ্কার করলেন স্বামীর গলায় ফাঁস দেয়া ঝুলন্ত দেহ! মানসিক যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল তার স্বামী ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। সাথে ছিল সুইসাইড নোট, “হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর জন্য আর অপেক্ষা করতে পারলাম না”। নিজের আবিষ্কারের কারণে কর্মস্থল থেকে শুরু করে নিজের দেশ, সকল জায়গায় অপমানিত হওয়া ডাক্তার ও বিজ্ঞানী সুভাষ মুখোপাধ্যায় নিজের হাতেই নিজের জীবনের ইতি টেনে দেন। বেঁচে থাকলে হয়তো নোবেল পুরষ্কারটাও তার পাওয়া হতো! অমিত প্রতিভাধর অভিমানী এই বিজ্ঞানীর কথাই আজ পাঠকদের সামনে তুলে ধরব।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩১ সালের ১৬ জানুয়ারি ভারতের বিহারের (বর্তমান ঝাড়খন্ড) হাজারিবাগে। ডাঃ সুভাষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে ফিজিওলজি নিয়ে বি.এস.সি পাশ করেন। এরপর ১৯৫৫ সালে কলকাতা জাতীয় মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি গাইনোকোলজি বিষয়ে প্রথম হয়ে এম.বি.বি.এস. পাশ করেন এবং ‘হেমাঙ্গিনী বৃত্তি’ লাভ করেন। এরপর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৮ সালে ‘রিপ্রোডাকটিভ ফিজিওলজি’তে পি. এইচ. ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে তিনি জন লোরেনের সঙ্গে হরমোন সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা করেন এবং ‘ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা’ থেকে দ্বিতীয় ডক্টরেট ডিগ্রি নেন ‘রিপ্রোডাকটিভ এন্ডোক্রায়োনলজি’র উপর। এরপর আরও গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার এবং একইসাথে চাকরি করার সুযোগ পেলেও, বিদেশে গবেষণা আর চাকরির লোভ ছেড়ে তিনি ফিরে আসেন নিজের দেশে, কলকাতাতেই। কলকাতার ‘নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে’ শুরু করেন কর্মজীবন।
১৯৭৫ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। গবেষণার প্রতি টানের কারণে প্রচলিত ডাক্তারি প্র্যাকটিস বলতে গেলে করতেনই না। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন’ (In Vitro Fertilization – IVF) যা সেইসময় ভারতবর্ষের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার! ১৯৭৮ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অন হরমোনাল স্টেরয়েডস’-এ এবং ১৯৭৯ সালে হায়দ্রাবাদে ‘ইণ্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস’-এ তিনি তাঁর এই আবিষ্কার সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তাছাড়া ১৯৭৯ সালেই ‘ইণ্ডিয়ান জার্নাল অফ ক্রায়োজেনিক্স’-এ একটি গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেন এই বিষয়ে। পরবর্তীকালে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নমিতা মুখোপাধ্যায়ের বিবাহ হয়। একটি সূত্র থেকে জানা যায় যে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাজের ব্যাঘাত হতে পারে বলে তারা কখনও সন্তান ধারণের কথা ভাবেননি। স্বল্প সম্পদ আর সুযোগেই তিনি তার গবেষণার কাজ এগিয়ে নিয়েছেন।
‘ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন’ পদ্ধতিতে টেস্টটিউব বেবির জন্মদান নিঃসন্তান দম্পতিদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। এটি হল এমন এক জটিল প্রক্রিয়া যার সাহায্যে মাতৃ-জরায়ুর বাইরে ডিম্বাশয়টি শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয় এবং তার পরে সেই নিষিক্ত ডিম্বাণুটি জরায়ুতে রোপণ করা হয়। ‘ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন’ বা টেস্টটিউব বেবি নিঃসন্তান দম্পত্তিদের জন্য এক আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর নিঃসন্তান দম্পত্তিরাও আজ টেস্টটিউব পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তানের মুখে ‘মা’, ‘বাবা’ ডাক শুনতে পাচ্ছেন। অথচ আমাদের বেশিরভাগেরই অজানা যে টেস্টটিউব বেবির সফল গবেষণা করেছিলেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী! ১৯৭৮ সালে রবার্ট এডওয়ার্ডসের গবেষণার ফল হিসেবে জন্ম হয় লুইস ব্রাউনের, পৃথিবীর সর্বপ্রথম টেস্ট টিউব শিশুর।
তখনও পুজো আসি-আসি করছে, আকাশে শরতের সাদা মেঘের আনাগোনা। ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষাশেষি এরকমই একটি দিনে আকাশভাঙা বৃষ্টি নামল। চলল দিন তিনেক ধরে টানা। ওই তিন দিনের মধ্যে প্রায় হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি ঝরেছে কলকাতার ওপরে। সবচেয়ে বেশি পড়েছে ২৭ সেপ্টেম্বর। পরদিন সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠে দেখে সারা শহর জলের তলায়। কাতারে কাতারে মানুষ জল ভেঙে চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। কারও মাথায় যৎসামান্য সম্বল পোঁটলা বাঁধা, কেউ বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে শিশু সন্তানকে, কেউ কোলে তুলে নিয়েছে পোষা কুকুরকে। মিছিলনগরী কলকাতায় এ-ও যেন এক হৃদয়বিদারক মিছিল।
দিন কয়েক পরে জল নামল, জীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিকের দিকে এগোতে থাকল। ওই ক’টা দিন জমা জলই ছিল সবচেয়ে আলোচিত খবর। কিন্তু অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে হঠাৎই খবরের অভিমুখ আচমকা বদলে গেল। এক বিকেলে দূরদর্শনে প্রচারিত হল একটি বিশেষ সংবাদ – ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবির জন্ম হয়েছে কলকাতায়! দিনটা ছিল ৩ অক্টোবর, ১৯৭৮। জন্ম হয়েছিল এক কন্যাসন্তানের। নাম কানুপ্রিয়া আগরওয়াল। দুর্গা পুজোর আবহে জন্ম বলে আর এক নাম ছিল ‘দুর্গা’। এই হল ভারতের প্রথম তথা সারা বিশ্বের দ্বিতীয় টেস্ট টিউব বেবি। পুরো কর্মযজ্ঞের প্রধান ছিলেন ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সহযোগী ক্রায়োবায়োলজিস্ট সুনীত মুখোপাধ্যায় এবং স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ সরোজকান্তি ভট্টাচার্য। দুর্গার জন্মের সময় তিনি দুর্গার মা বেলা আগরওয়ালের শরীরে যৌন হরমোন প্রয়োগ করেন। তারপর একাধিক ডিম্বাণু সংগ্রহ করে তৈরি করেন ভ্রূণকোষ এবং সেগুলিকে স্থাপন করেন মায়ের গর্ভে। এর আগে তিনি পাঁচটি ভ্রূণ তরল নাইট্রোজেনে ৫৩ দিন হিমায়িত রাখেন।
দূরদর্শনের পর্দায় দেখা গেল তিনজনকে। উপস্থাপক পরিচয় করিয়ে দিলেন মধ্যমণি চিকিৎসক, বিজ্ঞানী তথা গবেষক ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর দু’পাশে দুই সহযোগী- কলকাতার বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সরোজকান্তি ভট্টাচার্য ও ক্রায়োলজিস্ট সুনীত মুখোপাধ্যায়। সুভাষবাবু জানালেন, কীভাবে তাঁদের রাতদিন এক করা পরিশ্রমের ফসল ফলেছে। নিতান্তই সাধারণ কিছু যন্ত্রপাতি, আর ওঁর ফ্ল্যাটের রেফ্রিজারেটর, ব্যাস! এই সামান্য কারিগরি সহায়তা সম্বল করে দীর্ঘ বারো বছর ধরে সন্তান কামনা করেও নিষ্ফল এক দম্পতির কোলে এসেছে ফুটফুটে কন্যা সন্তান, তাঁদের নিজেদেরই। ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবি। হাসিমুখে সুভাষবাবু বললেন, তার নাম দেওয়া হয়েছে দুর্গা।
টেস্টটিউব শিশু – দুর্গা, পৃথিবীর দ্বিতীয়, আর ভারতের প্রথম টেস্টটিউব শিশু। ভারতের এক নিঃসন্তান দম্পত্তি দেখা পান তাদের সন্তানের মুখ। ২০১০ সালে রবার্ট এডওয়ার্ডস তার আবিষ্কারের জন্য ‘নোবেল পুরষ্কার’ পেলেও আবিষ্কারের পর নিজের দেশেই অবহেলা আর অপমানের মুখোমুখি হতে হয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে।
স্বীকৃতি তো দূর অস্ত! অভিযোগ‚ প্রথম ‘IVF’ চিকিৎসাকে নিয়ে প্রহসন করেছিল তৎকালীন বাম সরকার। ডক্টর মুখোপাধ্যায় দলের ঘনিষ্ঠ ছিলেন না। শাসক দলকে জানানোর আগে, তিনি প্রেসকে জানিয়েছিলেন! এটাই চক্ষুশূল ছিল সরকারের। এই ঔদ্ধত্য মেনে নিতে পারেননি তাঁরা।
যেকোনো আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি পাবার একমাত্র বৈধ উপায় হচ্ছে কোনো জার্নালে পাবলিশ করা। এতে পুরো কাজটি পৃথিবীর সকলকে জানানো যায় আর পুরো কাজের কৃতিত্ব চুরি যাবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু ডক্টর সুভাষ যখন তার কাজটি প্রকাশ করতে চাইলেন বাধা হয়ে দাঁড়ালো স্থানীয় প্রশাসন। যুগান্তকারী এই আবিষ্কারের খবর স্থানীয় পত্রিকার পাশাপাশি বিদেশেও কিছু জায়গায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু গবেষণা নিয়ে মেতে থাকা ডক্টর সুভাষ তার সহকর্মীদের ঈর্ষার কথা কল্পনাও করতে পারেননি। ডক্টর সুভাষকে যেখানে মাথায় নিয়ে নাচার কথা তখন তার আবিষ্কারকে হেয় করার জন্য গঠিত হয় এক প্রহসনের তদন্ত কমিটি!
তৈরি হয়েছিল কমিটি। শীর্ষে একজন রেডিও ফিজিসিস্ট। বাকিরা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ‚ সাইকোলজিস্ট‚ ফিজিসিস্ট ও নিউরোলজিস্ট। অভিযোগ কমিটি যেটা করেছিল সেটা হল চূড়ান্ত অপমান আর হেনস্থা।
ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল‚ ‘আপনি ভ্রূণ কোথায় রেখেছিলেন?’ উত্তরে ‘অ্যাম্পুল‘ শুনে আবার প্রশ্ন এসেছিল‚ ‘অ্যাম্পুলের মুখ বন্ধ করার সময়ে ভ্রূণ মরে যায়নি!’
লজ্জা, ঘৃণা, সঙ্কোচে স্রষ্টা শুধু বলতে পেরেছিলেন‚ ‘পার্ডন!’
শেষে কমিটি রায় দিয়েছিল‚ উনি যা বলছেন সব ফালতু! তাবড় তাবড় চিকিৎসকরা পারলেন না‚ আর ইনি কিনা লঝঝড়ে যন্ত্রপাতি দিয়ে এই যুগান্তকারী ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন! তদন্তের পর ডক্টর সুভাষকে বদলি করা হয় ‘বাঙ্গুর মেডিকেল কলেজে’। ১৯৮০ সালে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলে তাকে বদলি করা হয় ‘আর জি কর মেডিকেল কলেজ ও হসপিটালে’। এভাবে বারবার জায়গা বদলের ফলে গবেষণা পুরোপুরি থেমে যায় ডক্টর সুভাষের। তবে তাকে সবচেয়ে বড় অপমান করা হয় তার আত্মহত্যার মাত্র কিছুদিন আগে। ১৯৮১ সালের জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তাকে বদলি করা হয় চক্ষু বিষয়ক এক ইনস্টিটিউটে, ইলেক্ট্রো-ফিজিওলজির প্রফেসর হিসেবে। অথচ পি. এইচ. ডি. ডিগ্রি কিংবা গবেষণা দুটোই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে। ১৯৭৯ সালে জাপানের ‘কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের’ ‘প্রাইমেট রিসার্চ সেন্টার’ থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয় সেখানে গিয়ে তাঁর গবেষণা সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য। কিন্তু তৎকালীন সরকার তাঁকে জাপান যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। আর এই অপমানের ভার বইতে না পেরেই ১৯৮১ সালের ১৯ জুন আত্মহত্যা করেছিলেন নিজের বাড়িতে।
পরিস্থিতি দেখে ভয় পেয়ে দুর্গাকে নিয়ে তার বাবা-মাও কলকাতা ছেড়ে অন্য শহরে অজ্ঞাতবাসে চলে যান। মানুষ কালের নিয়মে আস্তে আস্তে ওই ঘটনা ভুলতে থাকে। শুধু ভুলতে পারেননি ডাঃ সুনীত মুখোপাধ্যায়। তিনি সুভাষবাবুর কীর্তি প্রচারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।
শেষের গল্পটা একটু ভিন্ন। অনেক দেরিতে হলেও নিজ দেশসহ পুরো পৃথিবীতেই স্বীকৃতি পেয়েছেন এই বিজ্ঞানী। সেটার গল্পটাও বেশ চমকপ্রদ। ১৯৮৬ সালের ১৬ আগস্ট ভারতেরই আরেক বিজ্ঞানী টি. সি. আনন্দ কুমারের ও গাইনোকোলজিস্ট ইন্দিরা হিন্দুজার গবেষণার ফলে জন্ম নেয় আরেক টেস্ট টিউব শিশু হর্ষবর্ধন রেডি। ভারত সরকার আনন্দ কুমারকেই ভারতের প্রথম টেস্টটিউব শিশু নিয়ে সফলতার স্বীকৃতি হয়। তবে সবকিছু পাল্টে যায় ১৯৯৭ সালে, যখন আনন্দ কুমার কলকাতায় যান এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতে।
কলকাতায় আনন্দ কুমারের হাতে আসে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নিগৃহীত কাজের বিভিন্ন ডকুমেন্ট। সেই ডকুমেন্টগুলো দেখে আর দুর্গার পরিবারের সাথে কথা বলে আনন্দ কুমার বুঝতে পারেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই ভারতে টেস্ট টিউব শিশু নিয়ে গবেষণার প্রথম সফল ব্যক্তি। দীর্ঘদিনের অবহেলা আর অপমানের পর আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনা পায় ডক্টর সুভাষের গবেষণা। আনন্দ কুমারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের প্রথম সফল টেস্টটিউব শিশুর গবেষক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আনন্দ কুমার নিজের মাথা থেকে সাফল্যের এই মুকুটটি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে দিতে একটুও দ্বিধা করেননি। আনন্দ কুমারের ভাষায়, “ডক্টর সুভাষকে অবশ্যই ভারতে প্রথম সফল টেস্টটিউব শিশু আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিতে হবে। তার আবিষ্কারের তুলনায় অন্যগুলো একেবারেই ছোট।”
আনন্দ কুমার ১৯৭৮ সালে গঠিত সেই তদন্ত কমিটির কড়া সমালোচনা করেছেন তার লেখায়। প্রহসনের সেই তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন একজন রেডিওফিজিওলজিস্ট আগেই বলা হয়েছে। অন্য সদস্যরা ছিলেন একজন গায়নোকলজিস্ট, একজন নিউরোফিজিসিস্ট ও একজন ফিজিওলজিস্ট। আনন্দ কুমারের দাবী অনুযায়ী এই চার সদস্যের তদন্ত কমিটির কারোরই আধুনিক প্রজননবিদ্যা বিষয়ক গবেষণা নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না, যার ফল ভোগ করতে হয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে।
পরে ২৫ বছর বয়সী কানুপ্রিয়া ওরফে দুর্গাকে হাজির করা হয়েছিল জনসমক্ষে। তিনি এখন জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। কর্মরতা দিল্লির এক বহুজাতিক সংস্থায়। তিনি নিজেকে ভারতের টেস্টটিউব শিশু গবেষণার ‘পোস্টার গার্ল’ হিসেবে দেখতে চান না বলেই জানান। বরং তার জন্মের পেছনে অবদান রাখা একজন ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানীর অবদানের স্বীকৃতিকেই সাফল্য হিসেবে মনে করেন। জন্মের পর তার ও পরিবারের সামাজিক লাঞ্চনার কথাও তিনি জানান।
যে সময় তাঁর বিশ্বনন্দিত হওয়ার কথা‚ সে সময় তিনি ঝুলছিলেন সিলিং ফ্যান থেকে! যে সময় অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার কথা‚ সে সময় তাঁর অকালে শেষ হয়ে যাওয়া! তিনি ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বড় ভুল সময়ে এসেছিলেন। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকাই ছিল তাঁর ‘অপরাধ‘। আমেরিকা কিংবা ইউরোপের আগেই স্বল্প রসদে কালজয়ী গবেষণাও যে সম্ভব সেটা অনেকেই মানতে পারেন না। দেরিতে হলেও ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন, এটাই স্বান্তনা। শুধু নিজের সাফল্যটা উপভোগ করার ভাগ্য তার হয়নি, তার আগেই অভিমান করে চলে গিয়েছেন সব কিছুর উর্ধ্বে।
তবে এখানেই শেষ নয়। ডঃ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণার কেন্দ্র ছিল কলকাতার ‘নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল’, সংক্ষেপে এনআরএস হাসপাতাল। এই এনআরএসেই বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার চালু করেছে সরকারের প্রথম টেস্টটিউব বেবি বা আইভিএফ সেন্টার। আরও আনন্দের বিষয় হল, চিকিৎসা হবে সম্পূর্ণ নিখরচায়। বর্তমানে অনেক দম্পতিই সন্তানহীনতায় ভোগেন। অথচ সবার আর্থিক সামর্থ্য সমান নয়। টেস্ট টিউব বেবি পরিষেবার সুযোগ নিতে পারেন না অনেকেই। এনআরএসের এই সেন্টার অনেক দম্পতির মুখেই হাসি ফোটাবে।
হাজারিবাগের সদর হাসপাতালে তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে তাঁরই একটি বিশালাকায় মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। অকালে শেষ হয়ে যাওয়া প্রতিভাবান জীবন নিয়ে সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী ‘অভিমন্যু’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন। এই উপন্যাস অবলম্বনেই ১৯৯০ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তপন সিংহ ‘এক ডক্টর কি মউত’ নামে একটি হিন্দি চলচ্চিত্র তৈরি করেন যা ‘জাতীয় পুরস্কার’ লাভ করে। শাবানা আজমি এবং পঙ্কজ কাপুর সেই ছবিতে অভিনয় করেন। ২০০০ সালে প্রকাশিত ‘ডিকশনারি অফ মেডিকেল বায়োগ্রাফিতে’ নিজের যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য রোনাল্ড রস এবং উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর সঙ্গে এক আসনে বসেছিলেন এই বাঙালি বিজ্ঞানী। এখন ভারতে প্রায় চারশোরও বেশি ‘ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন’ ক্লিনিক রয়েছে এবং এই পদ্ধতিতে হাজার হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে বর্তমানে।
প্রয়াত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে একটি গবেষণা কেন্দ্র তৈরির প্রচেষ্টা চলছে। এই পোড়া দেশে আমলাতান্ত্রিক সরকারের জন্য কত অকালে ‘স্মৃতি‘ হয়ে যেতে হয় এই রত্নদের। যাঁরা আরও অনেক অনেক আলো বিকশিত করবেন বলে আসেন সমাজে। কিন্তু হারিয়ে যান অদূরদর্শীদের অঙ্গুলিহেলনে। জীবনকালে নিজের আবিষ্কারের জন্য তাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হলেও, বর্তমানে তার সেই আবিষ্কারই উচ্চস্বরে গর্বিত কন্ঠে ঘোষণা করে ১৯ জুন তারিখটি শুধুমাত্র বাংলার এই কৃতি সন্তানের মৃত্যু দিন না, আমাদের পাপ স্বীকারেরও দিন।
★ তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :- রোর মিডিয়া, বাংলা লাইভ ডট কম, প্রহর ডট ইন, সব বাংলায়, ইনস্ক্রিপ্ট ডট মি, লিটারেসি প্যারাডাইস, জার্নি ডট ওয়ার্ডপ্রেশ ডট কম, প্রিয়লেখা ডট কম, পিউপিল পিল ডট কম, উইকিপিডিয়া।