#দেবীবাসুলী কি সত্যিই লৌকিক দেবী??লোকদেবী বাসুলি হলেও সাথে বিশালাক্ষীর স্বরূপের মিল রয়েছে। দেবী দ্বিভূজা ও রক্তবর্ণা। দেবী কালীর মতো মহাদেবের উপর দণ্ডায়মানা, ,মুণ্ডমালা ও পরিহিতা।দেবী বামহাতে রুধিরপাত্র ও ডান হাতে খড়গ ধারণ করেন। এই লৌকিক দেবী তান্ত্রিক প্রভাব রয়েছে। দেবীকে রক্তসরস্বতী হিসেবে ভাবা হয়।বাঁকুড়া জেলার ছাতনা । অতীতে এই ছাতনার নাম ছিল ছত্তিনানগর । প্রাচীন সামন্তভূম রাজ্যের রাজধানী ছিল এই ছত্তিনানগর । শুশুনিয়া পাহাড়ে পাওয়া গেছেরাজা চন্দ্রবর্মার শিলালিপি এটি বাংলার প্রাচীনতম শিলালিপি ।শুশুনিয়া পাহাড়ে এই ছাতনা থানা এলাকারই অন্তর্গত। ছাতনায় আছে বাসলি দেবীর মন্দির । দেবী বাসলী বা বাসুলি দুর্গার এই আর এক রূপ বলেই কথিত ।লৌকিক কাহিনী অনুযায়ী সামন্তভূমের তৎকালীন রাজা উত্তর হামিরার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন মা বাসুলির ৷ স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী বাসুলি দেবীর মূর্তি তৈরি করুন ।গোটা রাঢ়ভূমির জনপ্রিয় দেবী হিসেবে বাসলী মায়ের পূজা হতে শুরু করে তার পর থেকেই।যদিও ছাতনায় দুটো বাসুলি মন্দির আছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস পূজিত এই বাসলি দেবী।তবে প্রাচীন শাস্ত্রে দেবী বাসুলীর উল্লেখ আছে । তাই, বাসলী দেবী আদ্যাশক্তির রূপ বলা হয়। দক্ষিণা কালিকা স্তোত্রে আছে —‘বারাহী বাসলীচণ্ডী ত্বং জগুর্মুনয়ঃ সদা’।বাসলী বা বাশলী তেমন পৌরাণিক কাহিনীতে তেমন উল্লেখ নেই । তবু লৌকিক দেবীর তুলনায় তিনি কিছুটা আলাদা।কারণ লৌকিক দেবীর বছরের একটা নির্দিষ্ট দিন পূজা হয় সাধারণত।বাশলী দেবীর পুজো হয় বারোমাস।লৌকিক দেবীর পূজা হয় থানে। দেবীর প্রাচীন এবং স্থায়ী মন্দিরও। পুজোর ব্যাপকতা ও প্রাচীনত্বের কারণেই তাঁকে স্রেফ আঞ্চলিক দেবীর আওতায় ফেলা যায় না। আসলে দেবীর পুজো পদ্ধতি ও নামের সঙ্গে শাস্ত্রীয় দুর্গার বেশ মিল পাওয়া যায়। তাই এই দেবী দুর্গা আকৃতি ভেদে বা চণ্ডীস্বরূপা। তাছাড়া দেবীর আরেক নাম বিশালাক্ষী। অন্যদিকে এঁকে চৌষট্টি যোগিনীর অন্যতমা, রঙ্কিনীও সাথে মিল আছে। মনসা হিসেবেও তিনি পূজিতকোথাও কোথাও। আর্য-আর্যেতর কৃষ্টির সমন্বয়ে দেবীর সৃষ্টি। পরে হিন্দু সমাজের পূজা পাচ্ছেন। লৌকিক বিশ্বাসে দেবীর মান্যতা রয়েছে যথেষ্ঠই।দেবী মূর্তির ধরণ দুটি। প্রথমটি দ্বিভূজা, আর দ্বিতীয়টি চতুর্ভূজা। প্রথম ধরণ, দেখে দেবীর দ্বিভুজা মূর্তি লক্ষ্মী , সরস্বতীর প্রতি রূপ বলা চলে। গায়ের রং হলুদ। মাথায় মুকুট থাকতে পারে, তবে বেশিরভাগ মূর্তিতেই দেবী এলোকেশী ও সুদীর্ঘ ত্রিনয়নী । দেবীর এক হাতে বরাভয় অন্য হাতে প্রহরণ মূদ্রা থাকে। এদিকে তবে চতুর্ভুজা মূর্তিটি তিনি প্রহরণ ও মুদ্রা ভিন্নরূপ। দেবীর গলায় নরমুণ্ড। পরনে রক্তবস্ত্র। দেবীমূর্তি মাতৃস্বরূপা হলেও তা উগ্র। দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন মন্দিরে দেবীর এই রূপের দেখা মেলে। তবে লৌকিক ভাবে আবার দেবীর মুণ্ড পুজোরও চল রয়েছে। দেবীর পুজো পদ্ধতি ভিন্নতা থাকলেও। তিনি তান্ত্রিক দেবী। কিছু মন্দিরে সম্পূর্ণ গুহ্য তন্ত্রমতে তিনি পুজো পান। আবার তান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ মিশ্রিত পদ্ধতিতে পুজো হয়। তাই লৌকিক দেবী হলে পুজো হলে সেখানে কোনও নির্দিষ্ট মন্ত্রের প্রচলন হতো না। লৌকিক দেবীর নিত্যপূজারও চল নেই। একথায় দেবী লৌকিক আধারে থাকলেও, বাসুলীমাতাকে লৌকিক দেবীর তকমা দেওয়া যায় না।বাঁকুড়ার পাত্রসায়রের দাসপাড়ায় বাসুলী মন্দির একেবারেই সাদামাটা।জেলে সম্প্রদায়ের লোক পুজো করেন মায়ের। এখানে গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের লোকজনের বাস। এরা জলপথে বাণিজ্যের লবণ ব্যবসায়ের সঙ্গেই জড়িত ছিল। লবণের দেবী বাসিরী তথা বাসুলী এক ?গ্রিকদের লবণের দেবী অ্যাম্ফিট্রাইট, রোমানদের লবণের দেবী স্যালাজাক, প্রাচীন ইরানের লবণদেবী তিয়ামাত, আজটেকের পৌরাণিক কাহিনীতে আছে, Huixtocihuatl ছিলেন একজন দেবী, তিনি লবণ এবং নোনা জলের তত্ত্বাবধায়ক।ভারতে হিন্দুদের কোনও লবণদেবী নেই??তিনদিকে সমুদ্রবেষ্টিত দেশ ভারতে হিন্দুদের কোনও লবণদেবীর নেই?? লাবণ্য, লাবণী — মেয়েদের এই নামগুলি কিন্তু লবণ শব্দটি থেকে জাত। কর্ণাটক ও বিহারের গয়ায় বাসিরী (বাশুলী) বলে এক দেবী আছে । অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের মতো পণ্ডিত সেই দেবীকে সরস্বতী বা বাগীশ্বরীর একটি রূপ বলে মনে করেন। তাঁর মতে তান্ত্রিক সরস্বতী প্রথমে বাসুলী ও পরে মঙ্গলকাব্যের যুগে মঙ্গলচণ্ডীতে পরিণত হন। অনেকের মতে এই দেবী বিশালাক্ষীর রূপান্তর। বাসিরী (অপভ্রংশে বাসুলী) একজন লবণের দেবী। সংস্কৃত শব্দ বসির-এর অর্থ সামুদ্রিক লবণ। লবণের দেবী তাই বাসিরী। বাসিরী (অপভ্রংশে বাসুলী) একজন লবণের দেবী। লবণের দেবী তাই বাসিরী। কন্নড় ভাষার বহু শব্দ সংস্কৃত থেকে নেওয়া। সরস্বতী মূলত জলের দেবী।সরস্বতী মূলত জলের দেবী। তিনি পদ্মাসনা, হংসবাহনা, মুক্তাহার ধারিণী, কচ্ছপী বীণার অধিকারিণী। তাঁর সঙ্গে সামুদ্রিক লবণের দেবীর কিছুটা সাদৃশ্য তো থাকবেই! তাই লবণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বাসিরীর সঙ্গে সরস্বতীকে গুলিয়ে ফেলেছেন অনেকে। আবার লক্ষ্মী সমুদ্র মন্থনের ফলে উঠে এসেছিলেন। তাই তিনি লবণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দক্ষিণ ভারতে তিনি লবণের ধারক ও বাহক হিসেবে স্বীকৃতা। তাই লবণের দেবী বাসুলী আসলে সরস্বতী ও লক্ষ্মীর মিলিত রূপ।বাসুলী দেবী একটা কথা প্রমাণ করে নুনু তৈরী ছিলো বাংলাদেশের কুটির শিল্প। স্থাননামেও তাই বসির শব্দটি প্রভাব দেখা যায়। বসিরহাট শহর, হাবড়ায় বসিরহাটি, বসিরপুর, বসিরপাড়া, বসিরগাঁও, বসিরগঞ্জ — এসব জায়গাও আজ বাংলায় ছড়িয়ে আছে।তথ্য ঋণ – অসিত দাস।।