google-site-verification=r3lYzE3jI5XC8igrXRKdm9HAWALrzmx6coPmyeHNww4
Spread the love

হারাধন ভট্টাচার্য্য

পৃথিবীর কোন ভাষার কখন জন্ম হয়েছে এ কথা সঠিক ভাবে বলা যায় না, কারণ কোন ভাষার ই
কোন জন্ম তারিখ থাকে না। বিভিন্ন দিক থেকে বিচার বিবেচনা করে একটা কাল নির্নয় ই করা চলে। এভাবেই ভাষার নামের ও যুগে যুগে পরিবর্তন ঘটে। আজকে যে ভাষাকে আমরা সংস্কৃত ভাষা বলি , নিশ্চিত ভাবে বলা যায় এই নামটি ঐ ভাষার জন্মের কয়েক শতাব্দী পরে তার জন্য নির্ধারিত হয়েছে। এ ভাষাকে আর্য্যদের ভাষা বলা হয় এবং সাধারণ ধারণা আর্য্য জাতির লোকেরা এই ভাষায় কথা বলতেন। আসলে ” আর্য্য” শব্দটি কোন জাতিগত নাম নয়। এই শব্দের অর্থ মান্য, শ্রেষ্ঠ, পবিত্র বা পূজনীয় ইত্যাদি।
ইতিহাসানুসারে ” আরিয়ানাম” শব্দ থেকে ইরান নামটি এসেছে, যার অর্থ ” আর্য্যদের দেশ ” । ইতিহাস বলে সেখান থেকে ওরা ভারতে এসেছিলন, এবং এই কারণে ওদের ” আরিয়া” বা “আর্য্য ” বলা হয়েছে।
আরও একটি সম্ভব্য কারণ এই যে, তারা একবারে না এসে বারে বারে দলের পর দল কয়েক শতাব্দী পর পর বা তার চেয়ে বেশি সময়ের ব্যবধানে ভারতে প্রবেশ করে। তারা নিজেদের এখানকার প্রাচীন বাসিন্দাদের থেকে সভ্য এবং উচ্চ ভাবতেন।
এই অর্থেই নিজেদের “আরিয়া” বা “আর্য্য ” বলতেন।
আজ আমরা যে ভাষাটাকে ” সমস্কৃত” বা ” সংস্কৃত বলি সেই ভাষাটি আর্য্যদের ভারতে বসবাসের কয়েক শতাব্দী পর এই ভাষার Classical সাহিত্যের সময় তাকে একটি সভ্য এবং পরিবর্দ্ধিত ভাষা বলা হয় এবং বৈদিক ভাষা থেকে আলাদা করে একটি ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে সভ্য ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করার কারণে সমস্কৃত বা সংস্কৃত বলা হয়।
পাণিনি খৃষ্টপূর্ব পাঁচশ বছর আগে এই ভাষার ব্যকারণ রচনা করেন। কিন্তু যত দুর জান যায় তিনি নিজে এই সভ্য ভাষাকে সংস্কৃত বলেননি বা নামকরণ করেননি। এই ভাষার জন্য সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার আরও কয়েক শতাব্দী পর পাওয়া যায় , এবং বেশ কিছু ভাষা জ্ঞানীদের মতে দ্বিশত শতাব্দীতে রাজা শুদ্রকের সময় কালে এই ভাষাকে সংস্কৃত বলা হয়েছে।
উর্দু একটি আধুনিক ভারতীয় ভাষা। ভাষাতত্ত্ব বিদদের মতানুসারে সব আধুনিক ভাষাগুলির জন্ম আজ থেকে তেরশ থেকে চোদ্দোশ বছর পূর্বে হয়েছে। যদিও এই আধুনিক ভাষাসমূহের সাথে
সংস্কৃত ভাষার সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করা দুরূহ কাজ, কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, সংস্কৃতর পর প্রাকৃত এবং কালের নিয়মে তার অপভ্রংশ রূপ যাকে লোক ভাষাই বলা বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ অপভ্রংশের যুগ আসে। ভাষাচার্য সুনীতি কুমার বলেছেন “মুসলমানদের ভারতে আগমনের বহু আগেই পাঞ্জব, সিন্ধু,কাশ্মীর, রাজপুতানা,বঙ্গ দেশ নেপাল, মহারাষ্ট্র সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ভাষা বিস্তার লাভ করেছিল। প্রত্যেক অঞ্চলের ভাষার সাথে মিশ্রনে অপভ্রংশের নতুন নতুন রূপ পায়। ব্রজ ভাষা, অওধি ( অযধ্যা), হিন্দি, উর্দু ইত্যাদি ” সরসিনী” শাখা প্রশাখা। আজকে আমরা যে ভাষাকে উর্দু বলি, ভাষার এই নামকরণ অতি আধুনিক”।

তিনশো বছর আগেও উর্দু ভাষার জন্য উর্দু নাম ছিল না। ভারতে আরবেরা এলো,পাঠানরা এলো, তুর্কি এবং মোগলরা এলো । সবাই এখানে বসবাস করতে লাগলো। তাদের নিজ নিজ ভাষা ছিল আরবী, ফারসী, তুর্কি ইত্যাদি।এই সব ভাষার প্রভাব সহ এখানকার আধুনিক ভাষার অপভ্রংশ এবং দেশজ ভাষার মিশ্রনে ভারতবর্ষে এক নতুন ভাষার জন্ম হলো ।যে ভাষাকেবিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়েছে। কখনও একে ” রেখতা” বলা হয়েছে “রেখতা” ফারসী শব্দ এর অর্থ “ছড়ানো” কখনও “হিন্দেবী”বা হিন্দি। ভাষাচার্য সুনীতি কুমার বলেছেন ” এই রেখতা হিন্দি ই উর্দুর পূর্ব রূপ। শেষ পর্যন্ত ইংরেজ আগমনের পরে এই ভাষাকে উর্দু নাম দেওয়া হয়। উর্দু শব্দটি তুর্কি”ওর্দ ” শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ “শিবির” বা “ক্যাম্প” । সুবিখ্যাত কবি মীর তক্কি মীর এবং বিশ্ব বিখ্যাত কবি মির্জা গালিবও তাঁদের ভাষাকে উর্দু নামে আখ্যা দেননি।”আওদে- হিন্দি” বলেছেন। অর্থাৎ আজ যে ভাষাকে আমরা উর্দু বলে জানা সেই ভাষাটি ছিল, এবং প্রচলিত ছিল, কিন্তু তার নাম উর্দু ছিল না।”দোহা” যা আজও এই বিশাল দেশের বহু ভাষারই একটি জনপ্রিয় কাব্য পদ । এটিও অপভ্রংশের ই কাব্য পদ। প্রাচীন Classic ভাষা অর্থাৎ সংস্কৃত এবং প্রাকৃত ভাষার সাথে আধুনিক ভারতীয় ভাষাসমূহের মিলন সেতু হলো অপভ্রংশ।ঋকবেদের ভাষাকে ভাষাবিদ গন সংস্কৃত বলেন না , বরঞ্চ সংস্কৃত নাম হলো সেই প্রাচীন ভাষাটির যা ,ব্যাকারণবীদদের বানানো এবং নির্ধারিত মান হিসেবে উচ্চ কোটির উন্নত সাহিত্যের রূপ।উর্দুতে দোহা আজও প্রচুর লেখা হয়। এই আধুনিক দোহাতেও প্রাকৃত এবং অপভ্রংশের প্রভাব রয়েছে।হিন্দু মুসলিম কালচার ও সভ্যতার মিশ্রনে যে, নব সভ্যতা ও ভাষার সৃষ্টি হয় বিশ্ব বিখ্যাত কবি আমীর খসরুর লেখায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায়।আমীর খসরু রচিত “খালেখ্ বারি” গ্রন্থ থেকে পরিস্কার বোঝা যায় যে, সেই সময় ও এই নব্য ভারতীয় ভাষাটির যাকে আজ উর্দু নামে অভিহিত করা হয় তার অপরিসীম গুরুত্ব ছিল। আরবী ও তুর্কি যারা জানতেন তাদের জন্য এই নব্য ভাষা জ্ঞান অর্জন করা বিশেষ প্রয়োজন ছিল। নিশ্চিত করেই বলা যায় আমীর খসরু সে যুগের Classic সাহিত্যের ভাষা অর্থাৎ সংস্কৃত জানতেন। তিনি সংস্কৃত শব্দের কঠিন রূপকে পাশ কাটিয়ে সেই সময় সংস্কৃত শব্দ যে, সরল লোক রূপ নিয়েছিল তাকেই গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর কবিতায়, দোহায় সেই সরলীকৃত ভাষার প্রয়োগ করেন।উর্দুর শব্দ ভান্ডারে সরাসরি সংস্কৃত শব্দের প্রভাব খুবই কম। তার বদলে দেশজ ভাষার প্রভাব অনেক বেশি। উর্দুর শব্দ ভান্ডারে খড়িবোলি, ব্রজভাষা, অবধি এবং ভোজপুরি অর্থাৎ দেশজ ভাষার শব্দ ৭২% এবং আরবী ১৪%, ফারসী ১২% সংস্কৃত ১.৫% ইংরেজি সহ অন্যান্য.৫%।।

ভক্ত কবীরের যুগ আসার আগেই, সংস্কৃত শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় উচ্চ বর্ণের ভাষায় পরিনত হয়েছিল। সুতরাং সাধারণের সঙ্গে এর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
তাই সাধারণের “ভাষাই” হয়ে উঠেছিল কবীরের কাব্য ভাষা। কবীর তখন তাকে শুধু “ভাষা” নামে অভিহিত করে বলেছিলেন “সংস্কৃত হ্যায় কূপজল
ভাষা বহেতা নীর “।
কবীরের ভাষা আজও জীবিত। তাঁর ” বেজক ” এবং”বানীর ” দোঁহা গুলি আজও মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রভাব উর্দু সাহিত্য গ্রহণ করেনি। কারণ তা অসম্ভব।
সংস্কৃতের ধ্রুপদী কাব্য ও মহাকাব্য যেমন রামায়ণ, মহাভারতের বহু কাহিনীর চরত্রি অনুসরণ করে শত শত গল্প ও নাটক রচনা হয়েছে উর্দুতে ।রামায়ণ ও মহাভারতের একাধিক অনুবাদ আছে রামায়ণ ফারহৎ এবং, রামায়ণ ফারাকী
উর্দুতে খুবই জনপ্রিয় গ্রন্থ। মুন্সী শংকর দয়াল ফারহৎ এবং মুন্সী জগন্নাথ খুজতর। মুন্সী দুওয়ারকা প্রসাদ,রাম সহায়ে তামান্না ইত্যাদি লেখকেরা রামায়ণের অনুবাদ করেন। মুন্সী তোতা রাম সাঁখের মহাভারত অনুবাদ আজও শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। চকবস্তের কবিতা রামায়ণের একটি দৃশ্য এবং বানোয়ারী লাল সোলার ” সীতা হরণ ” উর্দু অনুবাদ সাহিত্যের অতুলনীয় কাব্য নাট্য । মুহম্মদ ইকবাল, জাকের আলী খাঁ এবং সাগর নিজামী শ্রী রামচন্দ্রের গুন কীর্ত্তন করেছেন। ১৮৬৪ সালে রঙ্গলাল চমন সংস্কৃত “সিংহাসন বত্রিশের” উর্দু অনুবাদ করেন।এর দু বছর বাদে মাখন লাল আরও একটি উর্দু অনুবাদ প্রকাশ করেন। ১২ শ শতাব্দীতে রচিত ভক্ত কবি জয়দেবের
“গীত গোবিন্দ” এর উর্দু অনুবাদ করেন মনব্বর লক্ষনৌভি।
এটা ঠিক যে সংস্কৃত নাটকের আগে থেকেই প্রাকৃত ভাষায় নাটক প্রভূত উন্নতি করেছিল। কিন্তু সংস্কৃত নাট্যকাব্য এই শিল্পকে উন্নতির উচ্চতর শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। উর্দু সাহিত্যে নাটক অনেক পরে এসেছে, কিন্তু উর্দু নাটকের ওপর সংস্কৃতের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল বলেই মনে করেন উর্দুর গবেষক এবং সমালোচকরা ।
অনেকেই এই মত পোষণ করেছেন যে, সংস্কৃতের প্রভাবেই উর্দু নাটকের আবির্ভাব হয়।
ক্রমশঃ

Verified by MonsterInsights