হাওড়া বর্ধমান মেন লাইনে একটি বৈঁচি স্টেশন। এখানে কালনা বৈঁচি বাস করে ৯ কিলোমিটার বৈদ্যপুর জনপদ । অন্য দিকে কালনা থেকে বাসে করে পশ্চিম দিকে বৈদ্যপুর জশনপদ ১৩ কিলোমিটার।বৈদ্যপুরের উল্লেখ পাওয়া যায় একাদশ-দ্বাদশ খ্রীষ্টাব্দে রচিত মনসামঙ্গল কাব্যে। কাহিনী অনুযায়ী লখিন্দরকে সর্প দংশনের পর বেহুলা এই বৈদ্যপুরেই আসেন বৈদ্যের খোঁজে এসেছিলেন এই জনপদে।বেহুলা নদীর নামও এসেছে এই কাব্য থেকেই।এই জনপদের নাম হয়তো তাই বৈদ্যপুর।বৈদ্যপুর কমপক্ষে পাঁচশো বছরের প্রাচীন জনপদ। এর প্রাচীনত্বের প্রমান রাজরাজেশ্বর মন্দির, পূজা বাড়ি, চালা মন্দির, রত্ন মন্দির, নহবত খানা,জমিদার বাড়ি, বৃন্দাবন চন্দ্রের মন্দির, কাছারি বাড়ি রাসমণ্ডপ , প্রভৃতি স্থাপত্যের নিদর্শন। তবে এখানের রথউৎসবটিও জনপ্রিয়। কমপক্ষে দু’শো বছরের প্রাচীন বৈদ্যপুরের রথ। তবে রথে জগন্নাথের জায়গায় স্থান পান রাজরাজেশ্বর ও বৃন্দাবনচন্দ্র। কাঠের তৈরি রথে বেশ কয়েকটি কাঠের বড় পুতুল ও ঘোড়া রয়েছে। এই রকম কাঠের কারুকার্য করা, বড়ো রথ বাংলা অন্য কোথাও কম চোখে পরবে ।১৪চুড়া রথ বলে খ্যাত এটি।বৈদ্যপুর রথ বাংলার দারু শিল্পের বিখ্যাত নিদর্শন। পশ্চিমবঙ্গের রথ গুলির মধ্যে বৈদ্যপুরের রথ বিশেষভাবে দর্শনীয়। মাহেশ এর, গুপ্তিপাড়ার রথ মতো বৈদ্যপুরের রথ বিশেষ ভাবে দর্শনীয়।এমন । ।ASI কর্তৃক অধিকৃত জাতীয় সম্পদ জোড়া রেখদেউল মন্দির। বিখ্যাত বৈদ্যপুর জমিদারদের কাহিনী, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে জায়গা করে নিয়েছে বলে কথিত আছে।পুরো এলাকাটাই ঐতিহাসিক উপাদানে ছড়াছড়ি। রাখালরাজা র মন্দির,হাজার বছরের প্রাচীন কষ্ঠি পাথরের মা জগৎগৌরির মন্দির,বৈদ্যপুর জমিদার বাড়ি ইত্যাদি।রাজরাজেশ্বর মন্দিরে কথা বলতে হয় এ প্রসঙ্গে।মধ্যম বর্ত্তুল যথা সপ্ত চক্র রয়ছত্র শর তৃন চিহ্ন যদি দৃষ্ট হয়রাজ রাজেশ্বর হয় তাহার আখ্যান কহিনু সবারে এই শাস্ত্রের প্রদান।। মন্দির গাত্রে দরজার মাথায় দেবতার স্বরুপ বর্ণনাটি লেখা আছে শ্বেত পাথরের ফলকে । কথিত আছে এই শিলার গায়ে সপ্তচক্র রেখা ছিল, যিনি রাজরাজেশ্বর নামে খ্যাত। আসলে এটি ছিল শালগ্রাম শিলা। এখানকার কষ্টিপাথরের নারায়ণ শিলা চুরি হয়ে যাওয়ার পর অন্য শিলা রাজরাজেশ্বর নামে পূজিত হয়। রুপোর সিংহাসনে রাজরাজেশ্বর অধিষ্ঠিত মন্দিরের ভিতর উঁচু বেদীর উপর। লোক কথা অনুযায়ী ২০০ বছর আগে নন্দীবংশের জমিদার শিশুরাম নন্দীর স্ত্রী এক রাতে স্বপ্নাদেশ পেলেন একটি নারায়ণ শিলা প্রতিষ্ঠা করলে তাঁদের ব্যবসা ও জমিদারিতে সমৃদ্ধি আসবে । এবং অলৌকিক ভাবে , পরদিন সকালে এক সন্ন্যাসী আসেন। এই সন্ন্যাসী তাদের একটি নারায়ণ শিলা দেন। ইনিই কুলদেবতা রাজরাজেশ্বর। সমৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সোনার সিংহাসনে দেবতা স্থান লাভ করেন। এবং উৎসব ও পূজা বেড়ে যায়। রথ, পঞ্চমদোল রাস উৎসব হতে শুরু হয়। জমিদার দেবতাকে সোনার সিংহাসনে পালকি করে পরিক্রমা করতেন। রাজরাজেশ্বর আছেন,নন্দী বংশের কুলদেবতা রুপে পূজিত হয়ে আসছেন।অতীতে সোনার সিংহাসনে থাকতেন এখন রূপোর সিংহাসনে থাকেন নিরাপত্তার জন্য। সারা বৎসর রাস,রথ,পঞ্চম দোল তিনি পালকি করে বাদ্য সহকারে শোভা যাত্রা করে বাহির হন,ঝুলন পূর্নিমাতেও পূজা বাড়ির ঝুলন উৎসবে শ্রী বৃন্দাবন চন্দ্রের সঙ্গে ঝুলনে থাকেন।বৈদ্যপুরের জমিদাররা বৃন্দাবন চন্দ্রের মন্দির, রাসমঞ্চ,দোল মঞ্চ,নয়চূড়া মন্দির, পূজা বাড়ি, কাছারি বাড়ি, বৈঠক খানা, রথ প্রতিষ্টা করে ছিলেন, সেই সব অধিকাংশ মন্দির ও এখন জীর্ণ দশা প্রাপ্ত। বৈদ্যপুরে নন্দী পরিবারে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগ থেকে বসবাস করছেন। তাঁরা ছিলেন নুন, সুপুরি এবং মশলার ব্যবসায়ী। ব্যবসার অর্থ প্রাচুর্য্য ফুলে ফেঁপে তাঁরা বিশাল জমিদারির অধিপতি হন। নন্দীদের আদিবাস ছিল আজকের হালি শহরের কেওটা গ্রামে। পরবর্তীকালে নন্দীদের একাংশ বৈদ্যপুর চলে এসে বসতি গড়েন। তাঁদের ব্যবসার গদি ছিলো বর্ধমানের কালনা, কোলকাতার বড়বাজার এলাকার পোস্তা এবং বেলেঘাটার খালপোলে ছিল । রাজারহাট অন্তর্ভুক্ত কেষ্টপুরের বারোয়ারিতলায় যে সুপ্রাচীন রাজ রাজেশ্বরী মন্দির আছে, তা এই নন্দী পরিবারেরই তৈরি।