google-site-verification=r3lYzE3jI5XC8igrXRKdm9HAWALrzmx6coPmyeHNww4
Spread the love

✍️ শমিক সরকার

গতকাল খবর হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী একটি জনসভায় পশ্চিমবঙ্গে মাহাতো সম্প্রদায়ের মানুষ কতজন আছেন, তা গুণবার জন্য একটি জনগণনার কথা ঘোষণা করেছেন। এর সরকারি নোটিশ এখনও অব্দি হাতে না এলেও আশা করা যায় এই জনগণনা শুধুই সংখ্যা নির্ধারণ করবে না; তা মাহাতো সম্প্রদায়ের সামাজিক অর্থনৈতিক চালচিত্রও গণনা করবে — যেমন, শিক্ষার হার, স্বাস্থ্যের হার, সরকারি বেসরকারি চাকরির হার, মাসিক গড় পারিবারিক আয়, স্বনিযুক্তি এবং ব্যবসার পরিমাণ, পারিবারিক জমির পরিমাণের গড়, ঘরবাড়ি কেমন ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গের কুর্মী-মাহাতো সম্প্রদায়ের তপশিলি জনজাতি (এসটি) বর্গের অন্তর্গত হবার দাবি দীর্ঘদিনের। তাদের বিশ্বাস, সংস্কৃতি, যাপন জনজাতিদের মতো — মূলতঃ এটাই যুক্তি। সম্প্রতি এই দাবির সপক্ষে পশ্চিমবঙ্গে কুর্মী-মাহাতো সংগঠনগুলি ব্যাপক জন-আন্দোলন গড়ে তুলেছে। লাগাতার হাইওয়ে ব্লক, রেল অবরোধের মতো জঙ্গী কর্মসূচীও সফল করেছে পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনিপুর এবং বাঁকুড়ার বহু মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। পুরুলিয়া এবং ঝাড়গ্রামে পঞ্চায়েত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বেশ কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েতে নির্বাচিত-ও হয়েছে। বলাই বাহুল্য, শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের দাপট এবং সরকারি দমন-পীড়ন সামলে এতটা দূর যাওয়া এই আন্দোলনের জনভিত্তি এবং গভীরতাকে দেখায়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, তপশিলি জনজাতি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া মানে তো শুধু কোনও একটি কৌমগোষ্ঠীর জনজাতি-ত্বের সরকারি স্বীকৃতি তো শুধু নয়; তা সঙ্গে করে নিয়ে আসে উচ্চশিক্ষা ও সরকারি চাকরি-তে পৃথক সংরক্ষণ থেকে শুরু করে নানা সরকারি প্রকল্পের বেশ কিছু সুবিধা। মাহাতো কৌমের এই আন্দোলন কি নিছক তার জনজাতি-ত্বের স্বীকৃতির দাবিতে, নাকি ওই সুবিধাগুলি পাবার একটি অছিলা মাত্র? আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, তপশিলি জনজাতি বর্গ-র অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে একটি কৌমগোষ্ঠী তখনই যখন তারা দেশের প্রত্যন্ত জায়গার বাসিন্দা, তাদের বিশ্বাস সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা স্বতন্ত্র ও তাতে আদিকালের ছাপ আছে, দেশের মূল ধারার সঙ্গে তাদের মেলামেশা কম এবং তারা পশ্চাদপদ। একথা ঠিকই যে কুর্মী-মাহাতো সম্প্রদায় এই প্রথম তিনটি বিষয়ে জনজাতিগুলির মতোই, কিন্তু চতুর্থটি ? পশ্চাদপদতার মাপকাঠি হয় এবং সেগুলি মাপাও যায় — একদম শুরুতে যেগুলির কথা বলা হল।

এ প্রসঙ্গেই আলোচনায় আসে জাতভিত্তিক জনগণনার প্রসঙ্গ। কেন্দ্রীয় সরকার দশম বর্ষীয় জনগণনা অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে, তাই এই দশকের শুরুতেই যে জনগণনা হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। এই আবহে বেশ কয়েকটি রাজ্য, মূলতঃ অবিজেপি সরকারগুলির নেতৃত্বে জাতভিত্তিক জনগণনা-র কথা ঘোষণা করেছে, যেমন তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক, ঝাড়খণ্ড। বিহারে বিগত নীতিশ-লালু সরকার জাতভিত্তিক জনগণনা (পোশাকি নাম জাতভিত্তিক সমীক্ষা) করে ফেলেছে; তার ফল প্রকাশ করেছে; এবং সেই ফলাফলের ভিত্তিতে সরকারি চাকরি ও উচ্চশিক্ষায় মোট সংরক্ষণ ষাট শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পঁচাত্তর শতাংশে নিয়ে চলে গেছে; তারপর সেই সংরক্ষণের ওপর দাঁড়িয়ে ব্যাপক পরিমাণে সরকারি চাকরিতে নিয়োগও সম্পন্ন করে ফেলেছে। বিহারে জনজাতির জনসংখ্যার নিরিখে তপশিলি জনজাতি বর্গের সংরক্ষণ ছিল এক শতাংশ। নতুন জাতভিত্তিক জনগণনার ভিত্তিতে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে দুই শতাংশ। যদি পশ্চিমবঙ্গে মাহাতো-জনগণনায় দেখা যায় যে ওই সম্প্রদায় জনজাতি বর্গের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য, তাহলে পশ্চিমবঙ্গেও জনজাতি বর্গের সংরক্ষণ এখনকার ছয় শতাংশ থেকে বাড়াতে হবে কুর্মী-মাহাতো সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে। এবং যেহেতু কুর্মী-মাহাতো সম্প্রদায় বর্তমানে ওবিসি জাতবর্গের অন্তর্ভুক্ত, ওবিসি জাতবর্গের মোট সংরক্ষণ আনুপাতিক হারে কমবে।

একইসাথে প্রশ্ন তোলা যায়, শুধু কুর্মী-মাহাতো সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা গোনা যথেষ্ট নয়। অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও সামগ্রিক জাতভিত্তিক জনগণনা করা প্রয়োজন। এবং অবশ্যই শুধু জনসংখ্যা গুনলে চলবে না, তার আর্থসামাজিক হালহকিকৎ -ও পরিমাপ করতে হবে, যেভাবে বিহারে করা হয়েছে। তবেই বিভিন্ন জাতবর্গের যে বিন্যাস আমাদের রাজ্যে রয়েছে, তার পুনর্বিন্যাস করা সম্ভব হবে। তখনই কেবলমাত্র সরকারি চাকরিতে এবং উচ্চশিক্ষায় ও অন্যান্য সরকারি প্রকল্পে সংরক্ষণ ইত্যাদির পুনর্বিন্যাস ও সম্প্রসারণও সম্ভব হবে। যে জাতগুলি উন্নয়নের মাপকাঠিতে এগিয়ে গেছে, তাদের পশ্চাদপদ জাতবর্গগুলিতে রাখা চলবে না। যেমন বিহারের জাতভিত্তিক জনগণনা দেখায়, বেনিয়া কৌমগোষ্ঠীকে আর সে রাজ্যে পশ্চাদপদ জাতবর্গে রাখার কোনও যুক্তি নেই, তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অগ্রসর জাতগুলির সমতুল্য (যদিও বিহার সরকার তা করেনি)। আর যে জাতগুলি পিছিয়ে আছে বা পিছিয়ে পড়েছে, তাকে সেইভাবে পিছিয়ে থাকা জাতবর্গের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বা রাখতে হবে। যেমন বিহারের জাত জনগণনা দেখায়, শেখ সম্প্রদায় কে ধরা হয় অগ্রসর বলে, কিন্তু তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা মোটেই অগ্রসরদের মতো নয়, বরং পশ্চাদপদ বর্গের জাতগুলির মতো বা কোনও কোনও মাপকাঠিতে তাদের চেয়েও খারাপ। ফলে তাকে অবশ্যই পশ্চাদপদ জাতবর্গে ঢোকানো দরকার (বলাই বাহুল্য, বিহার সরকার এটাও করেনি)। এবং পশ্চাদপদ জাতবর্গগুলিকে অবশ্যই বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিতে হবে; সরকারি চাকরি ও উচ্চশিক্ষায় সংরক্ষণ শুধু নয়, আরো নানা সহায়তামূলক প্রকল্প নিয়ে আসতে হবে তাদের জন্য যাতে তারা এগিয়ে যেতে পারে দ্রুত। কারণ ‘পশ্চাতে রাখিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’। পরবর্তী দশকের শুরুতে ফের জাতভিত্তিক জনগণনা করে হিসেব হবে কে কতটা এগোল, কতটা কে পিছিয়ে রইল বা পিছিয়ে গেল। সেই অনুযায়ী ফের জাতবর্গগুলি পুনর্বিন্যস্ত হবে। এইভাবে আমরা যদি সমতার ইঞ্জিন চালাতে পারি, তাহলেই দেশের সামগ্রিক উন্নতি হতে পারে; নইলে উন্নয়ন হয়ে থাকবে ব্যাপক মানুষের অনুন্নয়নের বিনিময়ে মুষ্টিমেয় মানুষের ফুলেফেঁপে ওঠা।

Verified by MonsterInsights